‌ঢাকা শহর এখন ‘বিস্ফোরণোন্মুখ’

তিন দিনের মধ্যে দুটি ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে, হয়েছে প্রাণহানি। কেন হচ্ছে?

লিটন হায়দারওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2023, 07:37 PM
Updated : 7 March 2023, 07:37 PM

একটির রেশ না কাটতেই আবার, তিন দিনের মধ্যে রাজধানীর দুটি ভবনে ঘটল ভয়াবহ বিস্ফোরণ। ১৫ দিন আগে গুলশানের একটি বাড়িতেও বিস্ফোরণের পর লেগেছিল আগুন। এসব ঘটনায় ২০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।

দুই বছর আগে মগবাজারে একটি চারতলা ভবন ধসে পড়েছিল বিস্ফোরণে, সেখানে নিহত হয়েছিলেন ১২ জন। এর বাইরেও ছোটখাটো বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটেছে ঢাকায় দুই বছরে।

ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় এসব বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে কখনও কখনও জমে থাকা গ্যাসকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আরও কিছু কারণও বেরিয়ে আসছে। তবে প্রতিকার কীভাবে হবে, তা নিয়ে কোনো কাজ দেখা যাচ্ছে না।

এই ধরনের দুর্যোগে যে সংস্থার কাজ বাড়ে, সেই ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলছেন, বাংলাদেশের রাজধানী এখন ‘বিস্ফোরণোন্মুখ’ হয়ে আছে।

কেন একথা বলছেন, তার ব্যাখ্যায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকা শহর গড়ে তোলা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এখানে ভূগর্ভস্থ পয়োবর্জ্য লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, গ্যাসের লাইন- কোনটা কোনদিক দিয়ে গেছে তা কারও জানা নেই।

“যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ মুহূর্তে বড় ভূমিকম্প হলে অর্ধেক মানুষই পুড়ে মারা যাবে। এটার মূল কারণ ‘ম্যাপিং’ নেই।”

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্পকে বড় ধরনের দুর্যোগ এই কারণে বলা হয়, কেননা এতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও থাকে, আর উদ্ধারকারী সংস্থার দপ্তর কিংবা হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা ভয়াবহ রূপ নেয়।

Also Read: গুলশানের সেই ভবনে ‘সব ছিল’, তারপরও …

Also Read: প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় মিরপুর রোডের বিস্ফোরণ

Also Read: সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণ: নিহত বেড়ে ১৭, উদ্ধার অভিযান স্থগিত

Also Read: ‘মানুষ উড়ে এসে পড়েছিল রাস্তায়, গাড়ির ওপরও’

ঢাকা শহরে গ্যাস, পানি, পয়োবর্জ্যের পাশাপাশি অনেক স্থানে বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও ইন্টারনেট লাইন রয়েছে ভূগর্ভে। এদের এক সংস্থা একটির কাজ করে থাকে, আর তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা নিয়ে আলোচনা বহু দিনের।

সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন হয়েছে ২০০৩ সালে। তার আগে নির্মিত ভবনগুলোর অবস্থা জানার জন্য ‘ম্যাপিং’ প্রয়োজন।

“ম্যাপিং হলে বোঝা যাবে, আমার পায়ের নিচে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, স্যুয়ারেজ লাইন কীভাবে আছে, কতটুকু ঝুঁকিতে আছে। এসব জানা গেলে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে, দুর্ঘটনা কমে আসবে। দুর্ঘটনা এড়াতে এখন ম্যাপিং করাটা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে আমরা কেউ নিরাপদ না।”

নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকা শহর এ ধরনের বিস্ফোরণের ঝুঁকিতে আছে। বিশেষ করে পুরান ঢাকায় এই ঝুঁকি বেশি।

“ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় পুরান ঢাকায় ঝুঁকি অনেক বেশি। সেখানে পুরোনো ইউটিলিটি সার্ভিস, তার সঙ্গে মিশ্র ধরনের এমন সব পণ্যের গুদাম আছে। দাহ্য, বিপজ্জনক পদার্থ সেখানে গুদামজাত করা হয়। রাস্তাঘাটও সরু, একবার কোনো ঘটনা ঘটলে উদ্ধার চালানো কঠিন।”

একের পর এক বিস্ফোরণ

  • ৫ মার্চ সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় মিরপুর রোডে তিনতলা একটি ভবন বিস্ফোরণে আংশিক ধসে পড়ে। ওই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তিনজনের; আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন।

  • ৩ মার্চ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানায় বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ওই ঘটনায় কেউ মারা যায়নি।

  • ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানে বহুতল একটি আবাসিক ভবনে বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়। প্রাণ বাঁচাতে লাফিয়ে পড়ে মারা যান দুজন।

  • ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ভাটারায় রান্নাঘরের গ্যাস থেকে আগুন লেগে স্বামী ও স্ত্রীর মৃত্যু হয়। সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে গ্যাস জমে এ অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে।

  • ১০ জানুয়ারি ঢাকার ধামরাইয়ে রান্নাঘরে গ্যাস জমে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তিন জন মারা যান।

কেন এত বিস্ফোরণ?

নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মঙ্গলবারের দুর্ঘটনার কারণ এখনও জানা যায়নি। সায়েন্সল্যাব, নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দেখা গেছে গ্যাস জমে এসব দুর্ঘটনা হয়েছে।

একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলছেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক উপ-পরিচালক (অপারেশন্স) দেবাশীষ বর্ধন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ধারণা, বিভিন্ন ধরনের গ্যাস থেকেই এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আজ (মঙ্গলবার) যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে তার আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল, সেখানে গ্যাস জমা হয়ে থাকতে পারে।”

সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি বিস্ফোরণের উৎস হিসেবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসিকে চিহ্নিত করা হয়।

বাংলাদেশে কতগুলো এসি সচল রয়েছে, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে উৎপাদক এবং বিক্রেতাদের তথ্যের বরাত দিয়ে বুয়েটের যন্ত্র কৌশল (মেকানিক্যাল) বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ হেলালী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সারাদেশে অন্তত ৮ থেকে ৯ লাখ এসি এবং প্রায় ৩০ লাখের বেশি রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করা হয়। অথচ এত সংখ্যক যন্ত্রপাতি মেরামত করার মতো দক্ষ জনবল বাংলাদেশে নাই।

তিনি বলেন, “এসব যন্ত্র যেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত করার কথা, দক্ষ জনবল না থাকায় সেগুলো সেভাবে করা হয় না। নিয়ম না মানা এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ।

“শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রগুলো যখন বানানো হয়, তখন সেটার মান খারাপ হওয়ার কথা নয়। যখন পুরোনো হয়, তখন এটার মেরামত ঠিকমতো করতে পারে না। গ্যাস বের হয়ে গেলে ঠিকমতো গ্যাস ভরতে পারে না। যারা জানে না, তাদের দিয়ে রিপেয়ার করা হয়। জানে না কিভাবে এটা মেরামত করতে হবে, উল্টাপাল্টা করে। আজেবাজে মানের উপকরণ ব্যবহার করে। এসব কারণে অঘটন ঘটে। এগুলো ফ্লেমেবল, এক্সপ্লোশন হওয়ার জিনিস, এজন্য এক্সপ্লোশন হয়।”

ভবন তৈরিতে যেসব উপকরণ ব্যবহার হচ্ছে, তা কতটা মানসম্মত তাও দেখার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক সাজ্জাদ হোসাইন।

দুর্ঘটনার হার বাড়লেও তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা না দেখার কথা বলেন নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ।

“একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।”

সরকারি তদারকি থাকলেও তা ‘দুর্বল’ বলে মন্তব্য করে সবার সচেতন হওয়ার উপর জোর দিচ্ছেন আকতার মাহমুদ।

“শুধু সরকারি উদ্যোগ এবং তদারকি দিয়ে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না। ঝুঁকি কমানো কঠিন হবে। আমাদের সরকারি তদারকি খুবই দুর্বল। দুর্ঘটনা রোধে ভবনের মালিক বা ব্যবহারকারী তাদের সচেতন হওয়া খুবই জরুরি।”