থার্ড টার্মিনালে যেন যাত্রীরা আন্তর্জাতিক মানের সেবা পান এজন্য টার্মিনালটির ব্যবস্থাপনার (হ্যান্ডেলিং) দায়িত্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটি জাপানি কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে।
Published : 07 Oct 2023, 12:45 AM
বাংলাদেশের মাহফুজুর রহমান এক দশক আগে যখন প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রে যান, তখনো ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ মনে আসেনি।
তবে বিদেশ বিভুঁইয়ের বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতার পর যতবার তিনি দেশে এসেছেন, ততবার মনে হয়েছে, ঢাকার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা খুবই খারাপ।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্রিন কার্ডধারী’ মাহফুজুর বলছেন, গত এক দশকে তিনি ভারত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেকগুলো দেশে ভ্রমণ করেছেন। অব্যবস্থাপনার তালিকায় ঢাকাকেই সবার ওপরে রাখছেন।
তিনি বলেন, “ঢাকায় আসবো শুনলে বউ-বাচ্চারা ভয় পায়। প্লেন থেকে নামার পর কখন ব্যাগ পাব তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। এখানে একবার দেড় ঘণ্টাতেও ব্যাগ না আসায় যাত্রীরা সবাই মিলে হইচই শুরু করে দিল, তখন আনসাররা বাঁশি বাজাতে শুরু করলে বাচ্চারা ভয় পেয়ে যায়। সেই স্মৃতি তারা এখনো ভুলতে পারে না।”
আকাশপথে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ভ্রমণ বা অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা- দুই যাত্রাতেই বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধার অভাব আর বিমানবন্দরের কর্মীদের আচরণ- দুইয়ে মিলে দেশের ভাবমূর্তির জন্য বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা।
এই চিত্র পাল্টাতে অর্ধ যুগ আগে সরকারের উদ্যোগের ফসল ঘরে তোলার সময় এসেছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নির্মাণ শেষের অপক্ষোয় তৃতীয় একটি টার্মিনাল।
এটি পুরোপুরি চালু হতে সময় লেগে যাবে আরও এক বছরের মত। তবে শনিবার সেটি উদ্বোধন হয়ে যাবে, যাবে ‘সফট ওপেনিং’ বলছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বেবিচক।
এই টার্মিনালটি যাত্রীদের সমস্যার অনেকটাই সমাধান করে দেবে- আশ্বাস দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
‘থার্ড টার্মিনাল’ নামে পরিচিত এই মেগা প্রকল্পটির ১০ শতাংশ কাজ বাকি রেখেই উদ্বোধন করা হচ্ছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলছেন, ‘সফট ওপেনিং’ এর মাধ্যমে এই স্থাপনাটি ব্যবহারযোগ্য করতে পরবর্তী ধাপে প্রবেশ করছেন তারা।
এখানকার স্থাপনা ও আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতিগুলো স্থাপন শেষ হয়েছে। তবে যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের (এখানকার কর্মীদের) যে অভ্যস্থতা তা সম্পন্ন হতে প্রায় এক বছরের মত সময় লেগে যাবে। আগামী বছরের অক্টোবরে এই টার্মিনালটা যাত্রীদের জন্য ব্যবহারযোগ্য করা যাবে।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, “ভবনটা প্রস্তুত হয়ে গেছে, ইকুইপমেন্টগুলো লেগে গেছে। এস্কেলেটর লিফট, ব্যাগেজ হ্যান্ডেলিং সিস্টেম, সিকিউরিটি ইকুইপমেন্টগুলো বসে গেছে। অনেকগুলো বোর্ডিং ব্রিজ বসে গেছে আর ও বসছে।
“আমাদের ফিজিক্যাল কাজ প্রায় শেষ। এখন ইন্টিগ্রেশনের পার্ট, ক্যালিব্যেশন এর কাজ বাকি। সফট ওপেনিং এর পর ওই প্রক্রিয়াগুলো চালু হবে। আপাতত ঠিকাদারের কাছ থেকে আমরা বুঝে নেব।”
যাত্রীসেবায় কী কী সংযোজন
বিমানবন্দরের পুরনো দুটি টার্মিনাল থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য রয়েছে আরেকটি টার্মিনাল।
পুরনো দুটো টার্মিনালের বছরে ৮০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়ার ক্ষমতা আছে। এর মোট ফ্লোর এরিয়া এক লাখ বর্গমিটার। জায়গা কম থাকায় যাত্রীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিত্যদিন। ভেতরের সাজসজ্জা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন ও অভিযোগ।
তিন তলা থার্ড টার্মিনালের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা বছরে এক কোটি ৬০ লাখ। এই টার্মিনালের মোট ফ্লোর স্পেস ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার।
টার্মিনালটির দেয়াল আর ছাদ রাঙানো হয়েছে ষড়ঋতুর ছয়টি রঙের বিশেষ টাইলস দিয়ে। বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই চোখে পড়বে জাতীয় ফুল শাপলা, জলে ভাসা পদ্ম।
নান্দকিতার পাশাপাশি যাত্রীদের জন্য অনেকগুলো সেবা পাওয়ার সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে নতুন টার্মিনালটি।
প্রকল্পের সঙ্গে একটি এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কার্গো টার্মিনাল, ৩৭ টা উড়োজাহাজ পার্কিং সুবিধার এপ্রোন করা হয়েছে। আগে শাহজালালে পার্ক করা যেত ২৯ টা উড়োজাহাজ।
টার্মিনালটিকে 'মাল্টি মডাল ট্রান্সপোর্টেশনের' সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। হাইওয়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেলওয়ে যে কোন উপায়ে যাত্রীরা এখানে আসতে যেতে পারবেন।
ওই এলাকা দিয়ে যে মেট্রোরেলের যে লাইন হতে যাচ্ছে সেটিও যুক্ত হবে এই টার্মিনালে। এতে থাকছে মাল্টিলেভেল কার পার্কিং, যেখানে ১ হাজার ২৩০টি গাড়ি থাকতে পারবে।
নতুন টার্মিনালের যাত্রীদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি কাস্টমস হলও থাকবে। সেখানে থাকবে ৬টি চ্যানেল। এতে লাগেজ বেল্ট থাকবে ১৬টি, চেক ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি। এর মধ্যে ১৫টিতে থাকবে অটোমেটেড চেকইন কাউন্টার। এর ফলে ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইন আর দেখা যাবে না।
টার্মিনালটিতে ইমিগ্রেশনের কাউন্টার থাকছে ১২৮টি, এর মধ্যে অটোমেটেড ১৫টি।
এসব কাউন্টারের মধ্যে বিদেশগামী যাত্রীদের ইমিগ্রেশন হবে ৬৬টি কাউন্টারে। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য থাকছে ৫৯টি। ভিভিআইপি ইমিগ্রেশন কাউন্টার হিসেবে থাকছে তিনটি।
প্রথম পর্যায়ে এই টার্মিনালের সঙ্গে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ যুক্ত থাকবে। প্রকল্পের বেঁচে যাওয়া অর্থ দিয়ে আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান জানান, নতুন টার্মিনালের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ঢেলে সাজানো হবে। যাত্রীদের ব্যাগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তল্লাশি হবে চার ধাপে। ব্যাগ খোলারই দরকার হবে না।
থ্যলাস কোম্পানি একটি ইন্টিগ্রেটেড কন্ট্রোলরুম করে দিচ্ছে। সেখান থেকে সব যাত্রীকে মনিটর করা যাবে। যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে এর হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব পিপিপির মাধ্যমে একটি জাপানি কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে।
পেছনের কথা
স্বাধীনতার ১১ বছর পর ১৯৮০ সালে কুর্মিটোলায় বিমানবন্দরটি চালু হয় ‘জিয়া আন্তর্জাতিক’ বিমানবন্দর নামে। পরে নাম বদল করে হয় হযরত শাহজালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
একটি ভবনে দুটি টার্মিনাল দিয়েই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার কাজ চলে আসছে এতদিন। গাদাগাদি ভিড় থাকে টার্মিনালের ভেতরে। ঢোকার মুখে, তল্লাশির জায়গা, চেক ইন বা ইমিগ্রেশনের কাউন্টার, সব জায়গায় লম্বা লাইন।
ওয়াইড বডির একাধিক ফ্লাইট একসঙ্গে অবতরণ করলেই লেগে যায় জট। ব্যাগ পেতেও অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘক্ষণ।
ভোগান্তির নানা অভিযোগ যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। এত কিছু সয়েও দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি আর এদেশে নানা কাজে আসা বিদেশিদের এই বিমানবন্দর দিয়েই যাতায়াত করতে হয়।
শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। পরে ব্যয় ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়।
জাইকার মাধ্যমে এই নির্মাণ কাজে অর্থায়ন করেছে জাপান।
নতুন স্থাপনায় ব্যবহার বদলাবে তো
যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ডধারী মাহফুজুর রহমান চিন্তিত অবকাঠামোগত উন্নয়নের ছোঁয়া বিমানবন্দরের কর্মীদের আচরণে লাগবে কি না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নতুন টার্মিনালেও যদি এই অব্যবস্থাপনাগুলো থাকে তাহলে আর এত পয়সা দিয়ে ভবন গড়ে লাভ কী?”
বেবিচক চেয়ারম্যান অবশ্য বলছেন, পাল্টাবে সব কিছুই।
যাত্রীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ, দুর্ব্যবহার, হয়রানি আর কয়েক দশক ধরে চলে আসা অভিযোগ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “ওই বিষয়গুলো আমাদের মাথায় আছে। এজন্য কয়েক বছর ধরেই বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। ইতিমধ্যেই অনেক পরিবর্তন এসেছে।”
থার্ড টার্মিনালে যেন যাত্রীরা আন্তর্জাতিক মানের সেবা পান এজন্য টার্মিনালটির ব্যবস্থাপনার (হ্যান্ডেলিং) দায়িত্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটি জাপানি কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বলেন, “আমরা আশা করি পুরনো অভিযোগগুলো আর শুনতে হবে না।”