গত শুক্রবার প্রথম প্রহরে নিজের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বুলবুল মহলানবীশ। সেখান থেকে সোমবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হয় মরদেহ।
Published : 17 Jul 2023, 03:52 PM
ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ।
সোমবার সকাল ১১টায় বুলবুল মহলানবীশের মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে। এ সময় তাকে স্মরণ করে স্মৃতিচারণ করেন সংস্কৃতি অঙ্গনের অগ্রজ এবং বুলবুলের সহযোদ্ধারা।
গত শুক্রবার প্রথম প্রহরে নিজের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বুলবুল মহলানবীশ। তার ছেলে বিদেশে থাকায় মরদেহ হিমঘরে রাখা হয়। সেখান থেকে সোমবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হয় মরদেহ।
শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী তিমির নন্দী বলেন, “স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের দুজন চলে গেলেন একই দিনে। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক আশফাকুর রহমান খান এবং শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ। তাদের দুজনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইল।”
চলে যাওয়ার পর মরণোত্তর পদক দিয়ে লাভ নেই উল্লেখ করে তিমির নন্দী বলেন, “মারা যাওয়ার পরে হয়ত সরকার মূল্যায়ন করে রাষ্ট্রীয় পদক দেবেন। কিন্তু আমার অনুরোধ, যারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে অবদান রেখেছেন, এখনো যারা জীবিত আছেন, তাদের দিকে একটু তাকান। চলে যাওয়ার পর মরণোত্তর দিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ সেই আনন্দটা যদি বন্ধু-পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে না পারল, সেই পদক দিয়ে তো লাভ নেই। তাই সরকারের দায়িত্বশীল জায়গায় যারা আছেন, তাদের ভাবার বিষয় যে, জীবিত থাকতেই যেন গুণিজনদের মূল্যায়ন করা হয়।”
বুলবুল মহলানবীশ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “তিনি ছোটবেলা থেকেই সংগীতচর্চা করতেন। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে আমাদের সাথে কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি কেবল সংগীতশিল্পী ছিলেন না, অভিনেত্রীও ছিলেন। তিনি নাটকে অভিনয় করেছেন। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে কল্যাণ মিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকে তিনি অভিনয় করতেন। এই নাটকটি অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। হঠাৎ করেই চলে গেলেন তিনি। তার চলে যাওয়াতে আমরা একজন সহযোদ্ধাকে হারালাম, তেমনি দেশ একজন রত্ন হারাল। আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার ছিল তার কাছ থেকে।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল মহলানবীশের মরদেহে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করা হয় এবং শোক বইয়ে সাক্ষর করেন উপস্থিত অনেকে। সবশেষে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষ হয়।
এ সময় বুলবুল মহলানবীশের স্বামী সরিত কুমার লালা বলেন, “আপনাদের ভালোবাসা বুলবুল চেয়েছিল। একটা কথা আমার মনে হয়, বুলবুল প্রচণ্ড জীবনমুখি ছিল। একটা পূর্ণজীবন সে যাপন করতে চেয়েছিল। কোনোরকমে বেঁচে থাকা, এটা তার ধাঁচে ছিল না। গত দু’বছর কিন্তু সেই জীবন সে যাপন করতে পারেনি। সে বেঁচে ছিল, কিন্তু মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে দিত না, কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম।”
গুণী এই শিল্পীর মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, কচি-কাঁচার মেলা, সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের কেন্দ্রীয় নারী কমিটি, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, থিয়েটার ৫২, মহিলা পরিষদ, ছায়ানট, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, স্বনন, বাংলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, নবান্ন উদযাপন পর্ষদ, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে শ্রদ্ধা জানান। তাদের মধ্যে ছিলেন রামেন্দু মজুমদার, আবুল বারক আলভী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আশরাফুল আলম, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, শাহীন সামাদ, সাংবাদিক আবেদ খান প্রমুখ।
শ্রদ্ধা নিবেদন করে সাংস্কৃতিক সংগঠক ও নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, “যে চেতনা নিয়ে বুলবুল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, সেই চেতনা কিন্তু সারাজীবন বহন করেছে। আমরা দেখেছি, অনেক বিরূপ পরিস্থিতিতেও বুলবুল মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছে। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের গান গেয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। বুলবুল চলে গেছে অনন্তলোকে, কিন্তু তার কথা আমরা সবাই মনে রাখব। তার হাসিমুখ এখনো অমলিন রয়েছে গেছে, দেখলে মনে হয় যেন ঘুমিয়ে আছে। এখনই বোধহয় তার কণ্ঠে গান ধ্বণিত হয়ে উঠবে। বুলবুলের যে আদর্শ আমরা যেন সেটা সমুন্নত রাখতে পারি। বুলবুলকে গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই।”
সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, “বুলবুলকে চিনি সেই ছোটবেলা থেকে। সে মনেপ্রাণে ভালোবাসত বাংলাদেশকে, মনেপ্রাণে ভালোবাসত মুক্তিযুদ্ধকে। এত পারিবারিক একটা মানুষ, এত সামাজিক একটা মানুষ। কারো বিপদে-আপদে বুলবুল অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আজকে বুলবুলের মরদেহের সামনে আমাকে কথা বলতে হচ্ছে। অথচ আমাকে নিয়ে তার কথা বলার কথা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যতদিন থাকবে, ততদিন সে থাকবে আমাদের মাঝে।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, “যে কজন মানুষ আমৃত্যু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জীবনযাপন করেছেন, বুলবুল তাদের একজন। অনেকের জন্য ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধটা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু বুলবুলের জন্য ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধটা শেষ হয়নি। আর শেষ হয়নি বলেই আমাদের সকল আন্দোলনে, সকল সংগ্রামে সে সামনে থেকেছে। রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য যে উপাদানগুলি অনুপস্থিত বা খামতি ছিল, সেগুলোকে যেন বিকশিত হয়, সে লক্ষ্যে বুলবুল সংগ্রাম করে গেছে। আমৃত্যু লড়াকু শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ। তার অংশগ্রহণে আমাদের সংগ্রামমুখর দিনগুলো বেগবান হয়েছিল, গতিশীল হয়েছিল। ওর যে গুণটা বেশি ভালো লাগত, ওর মুখে সবসময় একটা হাসি লেগে থাকত। সেই হাসিটা অমলিন।”
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই অর্জন হয়নি উল্লেখ করে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, “দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হয়নি। আমরা দেখছি মৌলবাদের উত্থান, তখন বুলবুলের মতো একজন সংগ্রামী মানুষের চলে যাওয়া। জনগণের জন্য এবং রাষ্ট্রের জন্য বিশাল ক্ষতি। তারপরও তার অবদানের জন্য, আমরা যারা তার সহযাত্রী ছিলাম, তাকে চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করব।”
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “বুলবুল সেই অল্পবয়সে নববধূর সাজে যখন সজ্জিত ছিল, তখন সেই নববধূর সাজ গুটিয়ে রেখে অল্পবয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। দেশ স্বাধীনের মুহূর্তে সেই কালজয়ী গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন যে কজন শিল্পী তাদের অন্যতম বুলবুল মহলানবীশ।”
বুলবুল মহলানবীশের পরিবার থেকে জানানো হয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালী মন্দিরে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।