Published : 23 Sep 2024, 08:37 PM
সরকার পতন আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনায় সুবিচার নিশ্চিত করার কথা জানিয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেছেন তারা কোনো প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসা দেখাতে চান না।
সোমবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ সংশোধন বিষয়ে একটি মতবিনিময়ে তিনি এ সব কথা বলেন।
আসিফ নজরুল বলেছেন, “গত জুলাই হত্যাকাণ্ডে জনগণ নিজ চোখে দেখেছেন একটি বৃদ্ধ প্রজন্ম দেশের একটি তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে ‘খুনের নেশায়’ মেতেছিল। আমাদের বুকের ভেতর যত কষ্ট থাক, যত হতাশা থাক, যত ক্ষোভ থাক- এই খুনের বিচারকে অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমরা প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার বিচার করতে চাই না। আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে চাই।”
অতীতে দেশে বিচারের নামে ‘অবিচার’ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করব।”
সরকার পতন আন্দোলনে প্রাণহানির বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার বিষয়ে প্রথমে কথা বলেছিলেন আসিফ নজরুল, যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে।
এরই মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন, এমনকি বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে।
ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের কাজও চলছে, মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদদের আইনজীবী তাজুল ইসলামকে চিফ প্রসিকিউটর করা হয়েছে।
আসিফ নজরুল বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে সচল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রসিকিউশন ও ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে। এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বোর্ড (ট্রাইব্যুনাল)-কে পুনর্গঠন করা।
“আমরা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের সংস্কার কার্যক্রম এখানেই থেমে থাকবে না। যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের সবার মতামত নিয়ে এই আইন সংশোধন করা হবে।”
যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব
প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনীতে আইনটির ৪এ, ১৩এ ও ২০এ নামে তিনটি নতুন ধারা এবং ৩(৩) ও ১২(২) নামে দুইটি নতুন উপধারা যুক্ত করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া ৩(২)(এ), ৪(২) ও ১৯ ধারায় সংশোধন আনার প্রস্তাবও রাখা হয়।
প্রথম সংশোধনীর প্রস্তাব রাখা হয় আইনটির ৩ নম্বর ধারায়। এখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় একটি ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণের অংশ হিসেবে গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক যৌনকর্ম, জোরপূর্বক গর্ভধারণ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
লিঙ্গ ও সাংস্কৃতিক কারণে যদি কোনো সাধারণ নাগরিকের উপর ব্যাপক ও ‘সিস্টেমেটিক’ আক্রমণ করা হয়, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। বর্তমান আইনে এটা নেই।
৩(৩) নম্বর ধারায় প্রস্তাবিত এ সংশোধনীতে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় নির্ধারণ করতে ট্রাইব্যুনাল রোম স্ট্যাটিউটে ৯ ধারা অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) ‘এলিমেন্টস অব ক্রাইম’ বিবেচনার সুযোগ পাবে।
৪(২) নম্বর ধারায় প্রস্তাবিত এ সংশোধনীর ফলে এ আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে এটি জানা সত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র, সত্ত্বার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাকেও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে। বিদ্যমান আইনে এটা সম্ভব নয়।
চতুর্থ সংশোধনীর প্রস্তাবে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজের ভিডিও স্ট্রিমিং বা অডিও-ভিজ্যুয়েল রেকর্ডিংয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। বিচার কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।
পঞ্চম সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী অভিযুক্ত চাইলে তার পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন।
ষষ্ঠ সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
সপ্তম সংশোধনী প্রস্তাবে প্রায় সব ধরনের ডিজিটাল সাক্ষ্যকে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অষ্টম সংশোধনীতে কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এলজিআরডি ও ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, শিল্প, গৃহায়ন, গণপূর্ত ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব (চলতি দায়িত্ব) হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদার, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না এই মত বিনিময়ে বক্তব্য রাখেন।
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, আইনজীবী সারা হোসেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বেগম আসমা সিদ্দীকা, জাতীয় পার্টির নেতা শামীম হায়দার পাটোয়ারী, ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী অফিসের কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সাংবাদিক সাঈদ আব্দুল্লাহ, সানজিদা ইসলাম, শরিফ ভূঁইয়াও তাদের মতামত তুলে ধরেন।