“ট্রানজিট তো অলরেডি দেওয়া আছে। ত্রিপুরা থেকে বাস ঢাকা হয়ে কলকাতা যাচ্ছে। আমরা রাস্তার ভাড়া পাচ্ছি, কিছু অর্থ উপার্জন করছি”, বলেন তিনি।
Published : 03 Jul 2024, 11:12 PM
ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে কী ক্ষতি হবে সেই প্রশ্ন সংসদে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভারতকে এই সুবিধা দিয়ে রাস্তার ভাড়া হিসেবে কিছু অর্থ উপার্জনের সুযোগের কথাও তুলে ধরেছেন তিনি।
বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় তথা বাজেট অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে বক্তব্য রাখেন সংসদ নেতা।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে ১০টি বিষয়ে সমঝোতা হলেও সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রেল কানেকটিভিটি। বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতের ট্রেন দেশটির এক অংশ থেকে আরেক অংশে পণ্য বা যাত্রী পরিবহন করবে। আবার বাংলাদেশ রেলওয়ে ভারতের মাটি ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটান যাবে, এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে দুই দেশ।
এরপর থেকে দেশে চলছে রাজনৈতিক বিতর্ক। বিএনপি এর বিরোধিতা করে বলছে, এতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে, দেশের নিরাপত্তা পড়বে হুমকিতে।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, “ট্রানজিট তো অলরেডি দেওয়া আছে। ত্রিপুরা থেকে বাস ঢাকা হয়ে কলকাতা যাচ্ছে। সেখানে ক্ষতিটা কী হচ্ছে? বরং আমরা রাস্তার ভাড়া পাচ্ছি। সুবিধা পাচ্ছে দেশের মানুষ। আমরা কিছু অর্থ উপার্জন করছি।
“আসামের নুমালিগড় হয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পার্বতীপুর ডিপোতে তেল আসছে। সেটা নাটোর পর্যন্ত আনব। ক্ষতিটা কী হয়েছে? বরং আমরা তেলটা সস্তায় কিনতে পারছি।”
বাংলাদেশ কেন বিচ্ছিন্ন থাকবে এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, “ভূটান থেকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত একটি রাস্তা যাচ্ছে। সেই রাস্তাটা যাচ্ছে বাংলাদেশকে বাইপাস করে। বিশ্বব্যাপী রোড হচ্ছে সেটা থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ। কেন বিচ্ছিন্ন থাকব?
“ভারত চাচ্ছিল এ রাস্তাটা ভুটান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারত ও মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড যাবে। এটা হলে আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে কত সুবিধা হত। সেটাও খালেদা জিয়া নাকচ করে দিয়েছিল। আমরা চারদিকে বন্ধ হয়ে থাকব। এই হল তাদের (বিএনপির) অবস্থা।”
‘আমরা নিজেদের দরজা বন্ধ রাখতে পারি না’
এমন মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। নেপাল, ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট পেয়েছি ভারতের।
“এটা একটা (ভারত) দেশ না। এটা আঞ্চলিক ট্রানজিট ও যোগাযোগ সুবিধার জন্য এটা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে এত বেশি কথা হচ্ছে তাই আমাদের এই কথাগুলো বলা উচিত।
“আজকে পৃথিবীটা হচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ। একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ব্যবসা-বাণিজ্য যোগাযোগের দরজা বন্ধ করে থাকা যায় না।”
মিয়ানমার থেকে ভারতে গ্যাস যাওয়ার পাইপলাইন অনুমোদন না দেওয়ায় সর্বনাশ হয়েছে বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “মিয়ানমারের গ্যাসক্ষেত্রে ভারত, চীন, জাপানের বিনিয়োগ ছিল। সেই গ্যাসটা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত যাবে, নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা একটা ভাগ নেব। এটা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাসের কোন অভাব হত না।
“খালেদা জিয়া সেটা হতে দেয়নি। কেন দেয়নি? আজকে সেই গ্যাস নিয়ে গেছে চীন। আর কোনো দেশ তো নিতে পারছে না। অথচ আমরা সেটা থেকে পেতাম। আমি সরকারে আসার পর অনেক চেষ্টা করেছিলাম, একটু গ্যাস আনতে পারি কি না। কিন্তু পারলাম না।”
নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশ মিলে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সেখানে ট্রানজিটের ব্যবস্থা। নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ কেনা শুরু করছি। গ্রিড লাইন করা.. আমরা সেই চুক্তিও করেছি এবং কার্যকরও করছি।
“১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে বন্ধ হওয়া রেল লাইন, সড়ক ও নৌপথ আমরা চালু করে দিচ্ছি।”
দেশ বিক্রি ‘ভাঙা রেকর্ডের মত’
ভারত সফর নিয়ে বিরোধী দলগুলোর সমালোচনাও জবাব দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি কিছু লোক আমার ভারত সফর নিয়ে নানা রকম কথা তুলেছে। ১৯৮১ সালে ছয় বছর পরে দেশে ফিরে আসার পর এই একই কথা শুনতে হয়েছে (ভারতের কাছে দেশ বিক্রি)। এখন জানি না এখন কেন সেই ভাঙা রেকর্ড বাজাতে শুরু করল।”
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে না পারার কারণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি বলে ভোট বেশি পেলেও ২০০১ সালে সিট বেশি পাইনি। এজন্য সরকার গঠন করতে পারলাম না। কারণ আমি গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি। তো বিক্রিটা করে কে দেশকে? করে গেছে তো খালেদা জিয়া, করেছে এরশাদ সাহেব, করেছে জিয়াউর রহমান। এরাই করে গেছে আওয়ামী লীগ করে না।
“৪০ টি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশ অধিকার দিয়ে আমাদের বাজারটাকে ভারতীয় পণ্যের বাজারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। ১৯৮০ সালে গ্যাস বিক্রির চুক্তিও করে আসে।
“১৯৯২ সালে ভারত গেল খালেদা জিয়া, সেখানে যৌথ ইশতেহার ঘোষণার ১১ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে ভারতে অনুপ্রবেশ করার কথা স্বীকার করে নেন। তারপরে পুশইন শুরু হয়েছিল। সেখানে আমাদের বহু মানুষ কষ্ট পেয়েছিল। এ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের জন্য আমরা সংসদে দাবিও করেছিলাম, কিন্তু কর্ণপাত করা হয়নি।”
জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের ভারত সফরে দেশের জন্য কোনো কিছুই আনতে পারেনি বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরে ভারত-বাংলাদেশের ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, তিন বিঘা করিডোর উন্মুক্তসহ বিভিন্ন অর্জনের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “খালেদা জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও জিয়াউর রহমান, কেউ তো এ সমাধানটা করতে পারেনি, করেনি।
“জেনারেল এরশাদও ভারতে গিয়েছিল। কী এনেছিল বাংলাদেশের জন্য? কিছুই না। পারলে সব দিয়ে আসে। হাঁটু ধরে বসেছিল।”
‘কারও গলা চিপে ধরছি না’
আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরেই গণতান্ত্রিক অধিকার মানুষের হাতে ফিরে এসেছে বলেও দাবি করেন শেখ হাসিনা। বলেন, “অত্যাচার-নির্যাতনের কথা শুনি। আমাদের কোন নেতা কর্মী বাকি ছিল নির্যাতনের হাত থেকে জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে?
সবাই জনসভা করছে, মিছিল করছে, বক্তৃতা করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা রেডিও, টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দিয়েছি বেসরকারিভাবে, ইচ্ছামত টক শো করছি। আমরা তো কারও মুখ চেপে ধরছি না, গলা চিপেও ধরছি না। যে যা পারছে, বলতে পারে বলুক। আমরা রাষ্ট্র চালাচ্ছি জনগণের কল্যাণে কাজ করছি।”
‘আমার হারানোর কিছু নেই’
গৃহহীন মানুষকে বিনা মূল্যে ঘর দেওয়ার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রতিটি ঘর স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দেওয়া হয়েছে এবং শর্ত অনুযায়ী দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ঘরের মালিকানা পাবে স্ত্রী।
কেন এমন শর্ত, সেটিও সংসদে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “তাকে আমি একটা ঘর দিলাম- নতুন ঘর পেয়ে যদি নতুন বউ নিয়ে আসে, তখন কী হবে? কাজেই নারী জাতির সুরক্ষা দেওয়া, এটা তো আমার দায়িত্ব। সে জন্যই আমি এ ব্যবস্থাটা করে দিয়েছি।
“আশ্রয়ণ প্রকল্প নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতার একটা বিরাট দৃষ্টান্ত। কারণ বাড়ির মালিক দুজনে সমান সমান।”
তার হারানোর ও পাওয়ারও কিছু নেই জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার একটাই লক্ষ্য- বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেশকে উন্নত করে দেওয়া।
“আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে আমরা কার্যক্রম অব্যাহত রাখব। এজন্য আমি সকলের সহযোগিতা চাই।
“আমাদের নবযাত্রায় আরো সাফল্য আসুন। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বাংলাদেশের মানুষ আরও উন্নত সুন্দর জীবন পাবে।”
শেষ হল সংসদ অধিবেশন
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর রাত ৯টার দিকে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দ্বাদশ সংসদের প্রথম বাজেট অধিবেশন শেষ হয়েছে।
অধিবেশন সমাপ্তি ঘোষণার আগে ১৯৭২ সালের ২৬ জুন আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে ক্রীড়া অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের রেকর্ড বাজানো হয়।
গত ৫ জুন শুরু হওয়া এই অধিবেশন মোট কার্যদিবস ছিল ১৯টি।
এ অধিবেশনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাসসহ ৭টি বিল পাস হয়েছে। এছাড়া তিনটি বিলের রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়েছে।
এবার বাজেটের ওপর ২৩৬ জন সদস্য ৪০ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেটের ওপর ২২৮ জন সদস্য ৩৮ ঘণ্টা ২৫ মিনিট বক্তব্য দিয়েছেন।
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর ৮ জন ২ ঘণ্টা ২২ মিনিট আলোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর জন্য ১১৭টি প্রশ্ন জমা পড়লেও তিনি উত্তর দিয়েছেন ৬৭টির এবং মন্ত্রীদের জন্য দুই হাজার ৩০০টি প্রশ্ন জমা পড়লেও উত্তর দিয়েছেন এক হাজার ৫২২টির।