“আমরা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করব, যেখানে মানবিক সম্পর্ক হবে ভয়মুক্ত। আমরা একে অপরকে দেখে ভয় পাব না, কথা বলতে ভয় পাব না,” বলেন তিনি।
Published : 05 Dec 2024, 11:10 PM
মানবিক ও ভয়মুক্ত সমাজ গঠনে জোর দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সবাইকে ক্ষোভ সংবরণের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “বহির্বিশ্বে কেউ কেউ আমাদের উসকানির সূত্রপাত করে। তাদের দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হয়রানি, ব্যবস্থার অভাব আমাদের ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং উসকানির জন্ম দেয়। এই দুটি বিষয় থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।
“ঘটনাকে স্বীকৃতি দেব তবে উসকানির শিকার হব না। এটা কিভাবে করতে পারি, সেটা শিখতে হবে।”
বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ধারাবাহিক সংলাপের অংশ হিসেবে ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সমাপণীতে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের ভিডিও তার দপ্তর থেকে সাংবাদিকদের পাঠানো হয়।
দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পরদিন ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রীতির কথা বলি, কিন্তু সম্প্রীতির মধ্যেও ভয় লুকিয়ে থাকে। ভয় না থাকলে সম্প্রীতির কথা আসত না।’’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, “কাজেই আমরা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করব, যেখানে মানবিক সম্পর্ক হবে ভয়মুক্ত। আমরা একে অপরকে দেখে ভয় পাব না, কথা বলতে ভয় পাব না।
“আমাদের এক পরিবার আরেক পরিবারকে দেখে ভয় পাবে না। আমাদের সন্তানরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগে ভয় পাবে না। এটা যদি করতে পারি, সেটি হবে আমাদের আদর্শ যেখানে যেতে চাই।’’
ইউনূস বলেন, “আমরা যে সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলেছি, সেগুলোর অনেকগুলোর সমাধানের পথ পেয়েছি। সেগুলো বাস্তবায়নে আমরা কাজ করব।’’
ক্ষোভ সংবরণের করতে না পারলে সব কিছু গোলমান হয়ে যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা এমনিতেই শান্তিতে আছি, কিন্তু কোনো একটি ঘটনা আমাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। এই ক্ষোভ যদি সামাল দিতে না পারি, তাহলে যত পরিকল্পনাই করি না কেন, তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই। কাজেই, ক্ষোভ সৃষ্টি করার সুযোগ যেন না হয়।
যদি কোনো ঘটনা ঘটেও যায়, তাতে উত্তেজিত না হয়ে ক্ষোভ সংবরণের বিষয়ে জোর দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ঘটনাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার উপায় নেই, কিন্তু আমাদের ক্ষোভ সংবরণ করতে হবে। যাতে ক্ষোভের আরেকটা কারণ সৃষ্টি না হয়। ক্ষোভ থেকে আত্মসংবরণ করা অত্যন্ত জরুরি।”
তিনি বলেন, “একটি দলকে, রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে এখান থেকে বিরত করেছি। তারা কিন্তু তাতেই শেষ হয়ে যায়নি, সম্পূর্ণ সমাপ্তও মনে করেনি। তারা দেশে এবং বিদেশে অবস্থান করছে। তারা সুযোগ পেলেই উসকানিমূলক কিছু একটা করবে। এই উসকানিকে চিহ্নিত করা এবং তাতে সাড়া না দেওয়া আমাদের শিখতে হবে।
“কখনো কখনো উসকানির বিষয় এত নিখুঁতভাবে হয় যে, বোঝা যায় না এটি উসকানি। আমাদের দায়িত্ব হবে উসকানির শিকার না হওয়া এবং প্ররোচনার উৎস চিহ্নিত করে তা মোকাবিলা করা।”
বহির্বিশ্বে উসকানির সূত্রপাত করার বিষয়টি তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “তাদের দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হয়রানি, ব্যবস্থার অভাব আমাদের ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং উসকানির জন্ম দেয়। এই দুটি বিষয় থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।”
ব্যক্তিগত প্রতিকার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিকারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
ইউনূস বলেন, “আমাদের মধ্যে ধর্মীয় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের ওপর বারবার আঘাত আসছে, যা আমাদের বিচলিত করে। এর ফলে এমন কিছু কাজ আমরা করেছি, যা সঠিক ছিল না।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন নতুনভাবে জন্ম লাভ করছে। কাজেই অতীতের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন বাংলাদেশের পথে এগিয়ে যেতে চাই।
“শুধুমাত্র সাময়িকভাবে কিছু ঘটনা সমাধান করাই যথেষ্ট নয়। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ তৈরি করব, যেখানে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে না। আর যদি ঘটেও, তা খুব শান্তিপূর্ণভাবে সামাল দিতে পারব। এ ধরনের রাষ্ট্র যেন আমরা গঠন করতে পারি—একটি ভয়মুক্ত রাষ্ট্র।”
তিনি বলেন, “আমরা নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। বর্তমানে যা আছে, তার কিছু রদবদল নয়; বরং একেবারে কাঠামোগতভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। যারা এই দেশে বসবাস করি, তাদের সম্পর্ক নতুন সুত্রে গাঁথতে হবে। এই জিনিসটি আমরা করতে পারব।”
এর আগে সূচনা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা সংখ্যালঘুদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে ধর্মীয় নেতাদের খোলাখুলি আলোচনার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘‘যাতে প্রকৃত অপরাধী শাস্তি পায় এবং মানুষ আনন্দিত হয় যে তাদের অভিযোগের প্রতিকার হয়েছে।”
তিনি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তথ্যপ্রবাহের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে জোর দেন এবং দোষীদের শাস্তির আওতায় এনে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে ইউনূস বলেন, বর্তমানেই সমস্যার সমাধান করতে হবে, ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা নয়।
বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, কবি ও রাষ্ট্র চিন্তক ফরহাদ মজহার, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) মহাসচিব মাহফুজুল হক, ইসলামি বক্তা ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমদুল্লাহ, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব আবদুল মালেকসহ কয়েকজন আলেম বৈঠকে অংশ নেন।
অন্যদের মধ্যে রমনার সেন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রালের ফাদার অলভার্ট রোজারিও, বাংলাদেশ বুডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বিক্ষু সুনন্দ প্রিয়, রমনা হরিচাঁদ মন্দিরের সহ-সম্পাদক অবিনাশ মিত্র, গারো পুরোহিত জনসন ম্যুরি কামালসহ হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একাধিক নেতারা সংলাপে অংশ নেন।