“আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্তিশালী কোনও ভূমিকা পালন করতে পারছে না। আর এটাকে বিশেষ সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছে অপরাধীরা,” বলেন অধ্যাপক ওমর ফারুক।
Published : 28 Mar 2025, 02:17 AM
“ঈদে ছুটি নাই, স্যার (বাড়ির মালিক) বাড়ি যায়। স্যার ফিরলে আমি ছুটি পাই। কয়েকদিন আগে থানা থেকে পুলিশ আসছিল। সবসময় লাইট জ্বালায়ে রাখতে বলছে। আরও বলছে, সিসি ক্যামেরা ঠিকঠাক আছে কি না চেক করে দেখতে। তারা বলছে, তারা তো সবসময় থাকবে না, আমরাও যাতে একটু সতর্ক থাকি।”
রোজার ঈদ ঘিরে নিরাপত্তা নিয়ে বলছিলেন ঢাকার আদাবর এলাকার এক বাসার নিরাপত্তাকর্মী আতাউর রহমান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এখনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটেনি।
এর মধ্যেই ঈদ করতে ঢাকা ছাড়ছেন প্রায় কোটি মানুষ। এসময়ে বাসা-বাড়ি, অফিস, বিপণিবিতানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় নগরবাসীর জন্য ১৪টি নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপি। সেসব নির্দেশনা মানলেও কতটা স্বস্তিতে থাকা যাবে, সেই প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।
তাছাড়া ঘরের বাইরে ঈদের মত আনন্দ উদযাপনে অনিরাপদবোধ করছেন অনেকে। সড়ক পথের নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশ তৎপরতা বাড়ালেও আস্থা পাচ্ছেন না কেউ কেউ।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদে ‘সামর্থ্যের’ সবটুকু দিয়েই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তারা ‘বদ্ধপরিকর’। সে অনুযায়ী সার্বিকভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ‘জোরদার’ করা হয়েছে।
বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বাসিন্দারাও বলছেন, পুলিশ তাদের সঙ্গে এরইমধ্যে যোগাযোগ করে নানান দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। অন্যবারের তুলনায় এবার বাড়তি ‘তৎপর’ থাকবেন তারাও।
তবে অপরাধ বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ‘নিজ ব্যবস্থাপনায়’ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের দেওয়া বক্তব্যকে অপরাধীরা ‘সুযোগ’ হিসেবে নিতে পারে, ফলে ‘বেড়ে যেতে পারে’ অপরাধ।
প্রতিবারের মত এবারও ঈদ উদ্যাপন করতে রাজশাহীতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন আদাবরের বাসিন্দা মোসলেম উদ্দীন। যাওয়ার দুর্ভোগ কমাতে এরইমধ্যে স্ত্রী-সন্তানদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন এ বেসরকারি চাকরিজীবী। বাসা ফাঁকা রেখে যাওয়া সবসময় দুশ্চিন্তার হলেও এবার ‘পরিস্থিতি’ বিবেচনায় রীতিমতো ‘ভয় ও আশঙ্কার’ কথা বলেছেন তিনি।
তার ভাষ্যে, “এবার দেশের যে অবস্থা, চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন রেগুলার বিষয়। এর মধ্যে লোকজন কমে গেলে ঢাকার অবস্থা কী হবে কে জানে? তারপরও পরিবারের সাথে ঈদ করতে বাড়িতে যেতেই হবে। বছরে দুইটা ঈদেই বাড়ি যাই।
“এবার পুলিশের পক্ষ থেকে বাড়ি বাড়ি এসে সিকিউরিটির বিষয়ে সজাগ থাকতে বলে গেছে। সিসিটিভি ক্যামেরা যেন ঠিকঠাক থাকে এবং দারোয়ানরাও দায়িত্বে গাফিলতি না করে এমন নির্দেশনা দিয়ে গেছে। তারপরও টেনশান নিয়েই বাসা ফাঁকা রেখে বাড়ি যাব। আশপাশে যারা থাকবে তাদেরকে বলে যাব, বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।”
খুন, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়াসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে মাসব্যাপী চলে যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। মার্চের প্রথমদিক থেকে এ অভিযানকে ‘ডেভিল হান্ট’ নামে ডাকা না হলেও অব্যাহত রয়েছে যৌথবাহিনীর অভিযান।
অভিযানের পাশাপাশি চুরি-ছিনতাই প্রতিরোধে রাজধানীজুড়ে ‘ব্যাপক টহলের’ কথা বলা হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ‘স্বস্তি ফেরেনি’ জনজীবনে। ৫ অগাস্টের পর শুরু হওয়া ‘মবের মাধ্যমে’ গণপিটুনি বা ভাঙচুরের মত ঘটনাও বন্ধ হয়নি, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মত অপরাধ।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছে না
পূবালী ব্যাংকের আইন কর্মকর্তা হেলাল কর্মস্থল মৌলভীবাজার যাওয়ার জন্য ৮ মার্চ রাতে ঢাকার দনিয়া এলাকার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। বাস ধরার জন্য রাত ১টার দিকে সায়েদাবাদের জনপথ মোড়ে পৌঁছালে ছিনতাইকারীরা তাকে আচমকা মারধর করে মোবাইল-মানিব্যাগ কেড়ে নেয়। মারধরে তার দুই হাত ভেঙে যায়।
টানা ৯ দিন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়ে হেলাল বাসায় ফেরেন ১৭ মার্চ। তার পুরোপুরি সেরে উঠতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
হেলালের স্ত্রী নুসরাত মেহজাবিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “সেদিন ছিনতাইকারীদের মারধরে তার দুই হাতে ফ্র্যাকচার হয়েছে, মাথায় আঘাত পেয়েছে। আসলে মুহূর্তের মধ্যে কী ঘটেছিল ঠিকঠাক করে সে মনেও করতে পারছে না, এখনও ঘোরের মধ্যে আছে।”
তিনি বলেন, “এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি, হাজব্যান্ডকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম। হাসপাতাল থেকে আমার মোবাইলটিও চুরি হয়েছে। যাই হোক- তাকে আল্লাহ বাঁচায়ে আনছে, এটাই বেশি।”
সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আইনজীবী হেলাল বলেন, “রোজার মধ্যে আগে মনে হত মাঝেমধ্যে বাইরে গিয়ে সেহেরি করি। এখন সেহেরি অনেক দূরের কথা, সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতেও ভয় লাগে।
“সারাক্ষণ মনে হয়- কাজ শেষ করে কত দ্রুত বাসায় ফিরব। বিশেষ করে, নারীদের জন্য চলাফেরা আরও বেশি অনিরাপদ হয়ে পড়েছে এখন।”
যাত্রাবাড়ী থানার ওসি কামরুজ্জামান তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভুক্তভোগীরা বলেছিলেন, হাসপাতাল থেকে ফিরে থানায় এসে মামলা করবে। তবে কোনও ঘটনা ঘটলেই আমরা কাজ করি, এটা নিয়েও আমরা কাজ করছি।
“এমনিতে প্রতিদিনই অভিযানে ছিনতাইকারীদের আমরা গ্রেপ্তার করি, কিন্তু স্পেসিফিক এই ঘটনায় এখনও গ্রেপ্তার নেই।”
বৃহস্পতি ও শুক্রবার ঢাকা মহানগরীর ৫০টি থানা এলাকায় ‘জননিরাপত্তা বিধানে’ মোট ১ হাজার ৩৩৪টি টহল ও ১৪২টি তল্লাশিচৌকি পরিচালনার কথা বলছে পুলিশ। এই দুইদিনে ‘সাঁড়াশি অভিযানে’ মোট ৩৯৩ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছে ডিএমপি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা বাড়ালেও নিরাপত্তা নিয়ে আশ্বস্ত হতে পারছে না অনেকেই। ফলে রাত-বিরাতে চলাফেরা করতে স্বস্তি পাচ্ছেন না তারা।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা, বেসরকারি চাকরিজীবী রায়হান আশরাফী বলেন, “আগে রোজা শেষের দিকে রাত-বিরাতে পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করতাম, ঘুরতে বের হতাম।
“এখন কেনাকাটা করা প্রয়োজন, তাই একদিন কোথাও গিয়ে কেনাকাটা করার পরিকল্পনা করেছি। দিনকালের যে অবস্থা- মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে ঝুঁকি নিতে চাই না।”
এর মধ্যে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার পল্লবীতে সেলিম নামে এক যুবককে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনা ঘটে, যিনি পোশাকে এমব্রয়ডারির কাজ করতেন।
এ ঘটনায় আবুল নামে একজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়ে পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কাইয়ূম বলেন, “পারভেজ নামে একজনের সঙ্গে নিহত সেলিমের পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং মাদক নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জেরে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। হত্যাকাণ্ডে অন্তত ৮-১০ জন অংশ নিয়েছে, বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”
বর্তমান পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেই বলে মনে করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা শক্তিশালী কোনও ভূমিকা পালন করতে পারছে না। নিয়ন্ত্রণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের যে পদক্ষেপগুলো নেওয়ার দরকার ছিল, সেগুলো আমরা নিতে পারি নাই।
“এক্ষেত্রে অপরাধী যারা আছে, এটাকে বিশেষ সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এই সুযোগের ভেতরে তারা অপরাধগুলো বাড়িয়ে চলছে। তারা মনে করে, একটা বিশৃঙ্খল এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য তাদের এটা উপযুক্ত সময়। তারা জানে আইনের আওতায় আসতে হবে না, তারা অনেক কিছু থেকে ছাড় পাবে। এই মনোবৃত্তি তাদের মধ্যে কাজ করছে বলে তারা অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে চলছে।”
প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থাকার পরও ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ মত অপরাধের পেছনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি একটি কারণ বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা তো ঠিক- আমাদের প্রচলিত আইনেই ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে।
“সে শাস্তিকে মাথায় রেখেও মানুষ অর্গানাইজডভাবে এই ক্রাইমগুলো করছে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একটা অন্যতম কারণ।”
আলোচনায় নারী-শিশু নির্যাতন
মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ‘ধর্ষণের শিকার’ হয়ে আট বছর বয়সী একটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা আলোড়ন তোলে দেশজুড়ে।
নির্যাতনের শিকার মেয়েটিকে স্থানীয় হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে চিকিৎসকদের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে ১৩ মার্চ দুপুরে মারা যায় মেয়েটি।
শিশুটির মা গত ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলা করেন, যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দিন দশেক পর ১৮ মার্চ রাতে ঢাকার খিলক্ষেতে একটি শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর ১৪ বছরের এক কিশোরকে আটক করে পুলিশ। গাড়িতে করে ওই কিশোরকে থানায় নিয়ে আসার সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন খিলক্ষেত বাজারের কাছে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে এবং ছেলেটিকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে পিটুনি দেয়। ওই সময় জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশের ৬ সদস্য আহত হন ও একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরদিন চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ধর্ষণের শিকার হওয়া ছয় বছরের শিশুটির শরীরে ‘ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। এই অভিযোগে গণপিটুনির শিকার হওয়া কিশোরের অবস্থা ‘শঙ্কামুক্ত নয়’ বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকরা।
খিলক্ষেত থানার ওসি কামাল হোসেন বলেন, “গণপিটুনির শিকার কিশোর ও ধর্ষণের শিকার শিশুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। আহত তিন পুলিশ এখনও হাসপাতালে রয়েছেন। তবে আহত পুলিশরা এখন শঙ্কামুক্ত বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।"
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে ৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। মাসজুড়ে ২৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়াসহ মোট শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ৪৭টি। ওই মাসে ৩৬টি শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
জানুয়ারিতে নারী ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৩৯টি, ওই মাসে ২৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়াসহ মোট ৩৭ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। জানুয়ারিতে শিশু হত্যার ঘটনা ছিল ৩৪টি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ‘ইউনিক রোড রয়েলস’ বাসে ডাকাতি ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা আলোচনার জন্ম দেয়। মামলা নিয়ে ‘গড়িমসির পর’ ২১ ফেব্রুয়ারি মামলার পর রাতেই তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত ১ মার্চ ঢাকার লালমাটিয়ায় আড়ংয়ের পাশে দুই তরুণীর প্রকাশ্যে ধূমপান নিয়ে গোলাম মোস্তাকীম রিংকু নামে এক ব্যক্তির ‘আপত্তি’ থেকে ‘বাকবিতণ্ডা’ ও মানুষ জড়ো হয়ে উত্তেজনা তৈরি হলে ঘণ্টা চারেক ধরে এ নিয়ে থানা-পুলিশ হয়।
পরদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ‘প্রকাশ্যে ধূমপান নিষেধ’ নিয়ে দেওয়া বক্তব্য ঘিরে তার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখান শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা-সমালোচনার পর ৯ মার্চ রাতে ‘হেনস্তাকারী’ রিংকুকে আটক করে পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে এখন নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে মন্তব্য করে মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা কিন্তু সবসময়ই ছিল, এটা ঠিক সংখ্যার দিক দিয়ে বিচার করলে সংখ্যাটা হয়ত এখন বেড়েছে।
“আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেহেতু অবনতি ঘটেছে, সেই সুযোগে দুষ্কৃতকারীরা অন্যান্য অপরাধ যেমন ঘটাচ্ছে, একইভাবে নারীর প্রতি সহিংসতাও করছে।”
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ বলেন, “পুলিশ অনেক কষ্ট করছে। শুধু দিনের বেলায় না, রাতের বেলায় গিয়ে দেখেন পুলিশ কাজ করছে কি না। আমরা হয়ত প্রত্যেকটা জায়গায় যেতে পারব না, কিন্তু ক্রাইম কমছে।
“ধর্ষণ বা নারী হয়রানির ঘটনা হঠাৎ করে কেন এত ঘটছে- আমি জানি না। কিন্তু দেখেন- প্রতিটা ঘটনায় আমরা উদ্ঘাটন করতে পারছি কি না। ঘটনা ঘটছে, আমরা রেসপন্স করছি কি না দেখেন।”
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ ‘এক কথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়’ বলে এড়িয়ে যান ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এ কে এম আওলাদ হোসেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, “আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এক্ষেত্রে মানুষেরও সহযোগিতা চাই, যদি কোনো ধরনের অপরাধ বা অপরাধী সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে, সেটি যেন আমাদের সাথে শেয়ার করে। সার্বিকভাবে আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছি।”
ঈদের নিরাপত্তা প্রস্তুতি কেমন
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী গত ৮ মার্চ নগরবাসীর উদ্দেশে বলেন, “আমি পুলিশ কমিশনার হিসেবে ডিএমপির পক্ষ থেকে আপনাদেরকে জানাতে চাই, অনুরোধ করতে চাই, দয়া করে যখন আপনি বাড়ি যাবেন; তখন দয়া করে আপনার বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, এটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজ দায়িত্বে করে যাবেন।”
এমন বক্তব্যের কারণে জনমনে আতঙ্ক বাড়তে পারে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক।
তার কথায়, “ঈদের নিরাপত্তা বড় কোনো বিষয় নয়, কিন্তু পুলিশের এমন বক্তব্য মানুষের মনে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। যারা বাড়ি যাবেন- চিন্তা নিয়েই যাবেন, চিন্তা নিয়েই থাকবেন। তাদের দেহ যাবে বাড়িতে, মন থাকবে ঢাকায়।
“আমাদের দেশের বাস্তবতায় একদিক থেকে ভালো, পুলিশ বলে দিচ্ছে- ‘আমাদের দ্বারা সম্ভব না’। ঢাকায় ৩০-এর অধিক এলাকায় ডাকাতির প্রবণতা বেশি। এ সমস্ত এলাকাগুলোতে যারা থাকেন, তারা এখন বুঝেশুনে সতর্ক হয়েই যাবেন। মানে যার যার নিরাপত্তা- তাকেই নিশ্চিত করতে হবে।”
তবে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “নিজ দায়িত্বে নিরাপত্তা বলতে এমন নয় যে- পুলিশ মাঠে থাকবে না। পুলিশ স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশিটুকু দিয়েই দায়িত্ব পালন করবে।
“কিন্তু প্রত্যেক নাগরিক যদি তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সতর্ক থাকেন, বাড়ি যাওয়ার সময় নিরাপত্তার বিষয়ে সার্বিক খেয়াল রাখেন- তাহলে ঝুঁকিটা অনেকাংশে কমে যায়। সেজন্য প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গা থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।”
বাস্তবতার নিরিখে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সোসাইটি, সমিতির তরফে নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে।
আবাসিক এলাকা নিকেতন সোসাইটির সিকিউরিটি ইনচার্জ বুলবুল আহমেদ বলেন, “পুলিশের পাশাপাশি আমাদের প্রতিদিনের টহল চলতেছে। ঈদ উপলক্ষে আমাদের সোসাইটি থেকে আরও কয়েক দফা মিটিং হবে। এরপর করণীয় বিষয়ে ফাইনালি সিদ্ধান্ত হবে।”
লালমাটিয়া এনএইচএ অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের প্রধান সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৫ অগাস্টের পর থেকেই আমরা সিকিউরিটি নিয়ে তৎপর রয়েছি, তখন থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। ঈদ উপলক্ষে এবার সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে বাড়তি তৎপর থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হবে।”
অন্যবারের তুলনায় এবার ঈদে বাড়তি সতর্ক থাকার কথা জানিয়ে শেওড়াপাড়া বাড়ি মালিক সমিতির সভাপতি আহাদ আলী বলেন, “আমরা আমাদের জায়গা থেকে সকল ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা মিটিং করে বাড়ি মালিকদের জন্য বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছি। সেসব নির্দেশনা লিফলেট আকারে আমরা প্রত্যেকটি বাসিন্দার কাছে পৌঁছে দিব।
“এবার আমরা কোনও নাইটগার্ডকে ছুটি দিচ্ছি না। তাদেরকে বলা হয়েছে, প্রত্যেকটা বাড়ির মালিক ঈদ শেষে ফিরে না আসা পর্যন্ত তারা এবার ছুটি পাবে না। এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো চেক করছি, সবগুলো সচল রয়েছে কি না। বাসিন্দাদেরও বলছি যারা বাড়ি যাবেন, তারা যেন দরজা-জানালা ভালোভাবে চেক করে যান।”
আহাদ বলেন, “পুলিশের পক্ষ থেকেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। একদিন মসজিদে এসে সবাইকে ব্রিফিং দিয়ে গেছে। সে অনুযায়ী আমরা প্রত্যেকটা নাইটগার্ডকে পুলিশের নম্বর দেব, যাতে সময়মত তারা প্রয়োজনে পুলিশকে ইনফর্ম করতে পারে।”
পুলিশ-র্যাবের কী ভাবনা
তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জুয়েল রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা মসজিদে মসজিদে মাইকিং করে ঈদের সময়ের নিরাপত্তার বিষয়ে মানুষকে বলছি, যেন বাড়ি যাওয়ার সময় তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করে যায়। যেমন সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলে চালু রাখা, দরজা জানালা বন্ধ রাখা, বিদ্যুৎচালিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বন্ধ রাখা এবং টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিরাপদ স্থানে রেখে যাওয়া।
“এছাড়া ঈদের আমাদের সর্বোচ্চ টহল চলবে। স্থানীয়ভাবে যারা ঈদে থাকবে, তাদেরকে পর্যাপ্ত লাইটিংসহ যে কোনো প্রয়োজনে পুলিশকে ফোন করতে বলা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক বাড়ির মালিক সমিতির সভাপতি-সেক্রেটারিকেও ব্রিফ করা হয়েছে। তারাও যেন তাদের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়।”
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “অনেক বাড়ির মালিক ঢাকা থেকে বাড়িতে ঈদ করতে যায়। এই সুযোগে বাসার দারোয়ানরা অনেকক্ষেত্রে শিথিলতা দেখায়। তারা যাতে এমনটা না করে মালিক সমিতির মাধ্যমে বলা হয়েছে।
“একইভাবে বিভিন্ন মার্কেটের দোকান মালিক সমিতি ও সেক্রেটারির সঙ্গে আমরা একাধিকবার বৈঠক করেছি। মার্কেটকেন্দ্রিক আমাদের ফোর্স মোতায়েন থাকে। তার পরেও সমিতিগুলোকে ঈদের পর পর্যন্ত নিজস্ব সিকিউরিটি ব্যবস্থা বলবৎ রাখতে বলা হয়েছে।”
ফাঁকা ঢাকার নিরাপত্তার পাশাপাশি ঈদযাত্রা নিয়ে নিজের এলাকায় বাড়তি প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদে মানুষ বাড়ি ফিরবে আবার ঈদের পরে ফিরবে। সে হিসেবে আমাদের নরমাল পুলিশিংয়ের পাশাপাশি সায়েদাবাদ টার্মিনালে কন্ট্রোলরুম স্থাপন করে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকবে না।”
ঈদে ফাঁকা ঢাকায় চুরি-ডাকাতির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে মন্তব্য করে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফট্যানেন্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, “একটু জনশূন্য হয়ে গেলে অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের টহল কার্যক্রম থাকবে এবং হটস্পটগুলোতে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত থাকবে।”
সারাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ঈদ উপলক্ষে র্যাবের সমস্ত ব্যাটালিয়নে সদর দপ্তর থেকে নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছি। জমজমাট শপিংমলগুলোতে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে, সাদা পোশাকে লোকজন রয়েছে।
“এছাড়া আমাদের নিয়মিত টহল কার্যক্রমের পাশাপাশি ঈদের সময় যেসব এলাকা একটু বেশি ক্রাউডি হয়, সেসব এলাকাতে টহল কার্যক্রম চলমান থাকবে।”
এর বাইরে ঈদযাত্রা ঘিরে লঞ্চ, বাস ও ট্রেন স্টেশনের টহলের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন র্যাবের এ কর্মকর্তা।
কাজ করছে ‘অক্সিলারি ফোর্স’
ডিএমপি বলছে, উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে ঈদ উদ্যাপনে এবং বাসা-বাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিপণিবিতানের সার্বিক নিরাপত্তায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ইতোমধ্যে ‘অক্সিলারি ফোর্স’ নিয়োগ করা হয়েছে।
কোনো ধরনের ‘বেতন-ভাতা ছাড়াই’ ঢাকার বিভিন্ন শপিংমল ও আবাসিক এলাকায় দায়িত্বরত বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের প্রধানদের পুলিশের ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৪১৯ জনের তালিকা করেছে পুলিশ।
এই ‘অক্সিলারি ফোর্স’ এবার ঈদের দায়িত্ব পালন করবে। পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে ডিএমপির ভাষ্য।
ঈদ ঘিরে ঢাকায় পুলিশ যেসব নির্দেশনা দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে-
• বাসা-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠান ছাড়ার আগে দরজা-জানালা সঠিকভাবে তালা মেরে যেতে হবে। প্রয়োজনে একাধিক তালা ব্যবহার করা যেতে পারে।
• অর্থ, মূল্যবান সামগ্রী ও দলিল নিরাপদ স্থানে বা নিকট আত্মীয়ের হেফাজতে রেখে যেতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংক লকারের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
• বাসা-বাড়ি ছাড়ার আগে যে প্রতিবেশী বা পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা ঢাকায় থাকছেন, বাসার দিকে তাদের খেয়াল রাখতে অনুরোধ করতে হবে। ফোনে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।
• ভাড়াটেরা আগেই বাসার মালিককে ঈদ উপলক্ষে বাসায় না থাকার বিষয়টি জানাবেন।
• অনুমতি ছাড়া কেউ যেন বাসা বা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে না পারে, এ বিষয়ে বাসা বা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মীকে সতর্ক করতে হবে ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে হবে।
• বাসা-বাড়ি বা প্রতিষ্ঠান ছাড়ার আগে লাইট, ফ্যানসহ অন্যান্য ইলেকট্রিক লাইনের সুইচ, পানির ট্যাপ, গ্যাসের চুলা ইত্যাদি বন্ধ করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
• জরুরি প্রয়োজনে পুলিশি সহায়তার জন্য ডিএমপি কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করা যাবে ০১৩২০০৩৭৮৪৫, ০১৩২০০৩৭৮৪৬, ২২৩৩৮১১৮৮, ০২৪৭১১৯৯৮৮, ০২৯৬১৯৯৯৯ নম্বরে। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমেও পুলিশের সেবা পাওয়া যাবে।