“উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক সমাধান দরকার আমাদের,” বলেন ঢাকা সফরে আসা ইউরোপীয় জোটের কমিশনার হাদজা লাবিব।
Published : 03 Mar 2025, 10:55 PM
প্রত্যাবাসন আটকে থাকার মধ্যে মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরতা কমাতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত করার প্রস্তাব দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের পর ইউরোপীয় জোটের কমিশনার হাদজা লাবিব এ প্রস্তাবের কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, মানবিক সাহায্যের উপর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নির্ভরতা কমাতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে নজর দেওয়া উচিত। শরণার্থীদের অর্থনৈতিক ও জীবনজীবিকার সুযোগকে জোরালো করার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের উপকার করবে, এমন উদ্যোগকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহযোগিতা দিতে চায়।
“উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক সমাধান দরকার আমাদের। যেমন, ক্যাম্পে ক্ষুদ্র ব্যবসা চালুর সুযোগ দিলে রোহিঙ্গাদের ক্ষমতায়িত করার পাশাপাশি সরবরাহকারী হিসেবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীও উপকার পাবে। তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে এটা গুরুত্বপূর্ণ।”
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যার মুখে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টের পর রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে স্রোতের মত ঢুকতে শুরু করে রোহিঙ্গারা।
কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। যেখানে আগে থেকেই ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ওই বছরের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চির সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও তারা সই করে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি রোহিঙ্গারা, ফলে ভেস্তে যায় আলোচনা।
এরপর আসে কোভিড মহামারী; রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগেও ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সংকটের মধ্যেই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসে নতুন ধাক্কা।
এরপর নানা সময় উদ্যোগ নিয়েও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। উল্টো মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাতের কারণে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আলোচনাতেই নেই।
এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আরও ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্য দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নতুন শিশুর জন্ম হচ্ছে। এতে সেখানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে।
মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া সব এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি দখলে চলে যাওয়ার মধ্যে নেপিদোর সঙ্গে যোগাযোগেও ভাটা পড়েছে ঢাকার।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশে বিশ্বব্যাপী দেশটির সব উন্নয়ন সহযোগিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত হওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভরণপোষণ নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
কেননা একক দেশ হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় দাতা যুক্তরাষ্ট্রই। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জরুরি খাদ্য সহায়তার ক্ষেত্রে অর্থায়ন চালু থাকার কথা দেশটির বরাতে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রত্যাবাসন আটকে থাকার মধ্য রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত এবং তাদেরকে ক্যাম্পের বাইরে চলাচলের সুযোগের বিষয়টি উন্নয়ন সহযোগীরা নানা সময়ে তুললেও বাংলাদেশ তাতে সায় দেয়নি।
এর মধ্যে বাংলাদেশ সফরে এসে রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমতা, প্রস্তুতি এবং সংকট ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিশনার হাদজা লাবিব।
এরপর সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানের পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে হাদজা লাবিব এ প্রস্তাব তুলে ধরার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য ৬৮ মিলিয়ন ইউরোর নতুন অনুদানের ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, ৬৮ মিলিয়ন ইউরোর এই সহযোগিতা বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের পাশাপাশি এই অঞ্চলে অন্যান্য দেশে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় খরচ হবে। এর মধ্যে ৩২ মিলিয়ন ইউরো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য।
এর বাইরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা অংশীদারদের জন্য ৩৩ মিলিয়ন ইউরোর বেশি এবং ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় ৩ মিলিয়ন ইউরো খরচের কথা জানান তিনি।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করতে ইইউ’র উদ্যোগের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশকে সর্বতোভাবে সমর্থন দিচ্ছি এবং আমরা সব ধরনের উপায় ব্যবহার করছি।
“তার মানে হচ্ছে, কূটনীতি, মিয়ানমারের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চাপ প্রয়োগ, পাশাপাশি অর্থনৈতিক চাপ এবং বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানকারীদের সহায়তা। সুতরাং প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে যে আলোচনা চলছে, আমরা সেটাকেও সমর্থন জানাই। আমরা জানি, কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠাই হল স্থায়ী সমাধান।”
বাংলাদেশের পালাবদলে ইইউ ‘নির্ভরযোগ্য অংশীদার’
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে সমর্থন অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশনার হাদজা লাবিব।
তিনি বলেন, ”এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিয়ে আমি শুরু চাই, ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর ভরসা রাখতে পারে বাংলাদেশ। আমরা নির্ভরযোগ্য অংশীদার।
“শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক পালাবদলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমর্থন দিয়ে যেতে চায়; যেটা (সংস্কার প্রক্রিয়া) সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারর প্রতি শ্রদ্ধায় নিবদ্ধ।”
বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউ’র ‘সম্পৃক্ততা ত্বরান্বিতকরণ এবং সম্পর্কটাকে আরও উন্নত পর্যায়ে নেওয়ার সম্ভাবনাকে’ সেই সহযোগিতার অগ্রভাগে স্থান দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
ইইউ কমিশনার বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, উন্নয়ন, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং অন্যান্য পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অংশদারত্বকে আরও জোরদার করতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
মিয়ানমারে সংঘাত চললেও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাগাদা দিতে হবে: ফিলি