“আমরা দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করব, এজন্য এখনো পর্যন্ত আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ করিনি,” বলেন তিনি।
Published : 10 Mar 2025, 01:12 PM
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।
তিনি বলেছেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে ৩৪টি দল ও জোটের কাছে ১৩ মার্চের মধ্যে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
“এই প্রক্রিয়ার পরের ধাপ নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আমরা চাই- দ্রুত আলোচনা করতে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঐকমত্যে পৌঁছে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে।”
সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন আলী রিয়াজ।
তিনি বলেন, “দলগুলোর কাছ থেকে তাদের মতামত প্রাপ্তি সাপেক্ষে আমরা দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করব। এজন্য এখনো পর্যন্ত আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ করিনি।
“যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে, সেই সময় থেকেই আলোচনা শুরু হবে।”
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুথানের পর মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন। এরই মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ সংস্কারের জন্যে গঠিত ছয় কমিশন তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
এসব সুপারিশ বিবেচনা ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করতে ঐকমত্য কমিশন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। আর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ। বাকি কমিশনগুলোর প্রধানরাও ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।
ছয় মাস মেয়াদি এ কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু করে জানিয়ে সহ-সভাপতি আলী রিয়াজ বলেন, কমিশনের যাত্রার দিন প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশন সভাপতি অধ্যাপক ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সৌজন্য সভা হয়। ওই সভায় ৩৪টি দলের মোট ১০৪ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, সভায় অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ৩৪টি দলের কাছে ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের অনুলিপি ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। ইতোপূর্বে সব দলকে প্রতিবেদনগুলোর ‘সফট কপিও’ পাঠানো হয়।
এরপরে ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তিন দফা বৈঠক করে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ চিহ্নিত করেন বলে জানান আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, “পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছক আকারে বিন্যস্ত করা হয়। এসব ছকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে যুক্ত করা হয়নি।
“পুলিশ সংস্কার কমিশন মনে করে যে, তাদের সুপারিশসমূহ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব।”
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি জানান, মোট ১৬৬টি সুপারিশ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত ২০টি সুপারিশ রয়েছে।
ওই সুপারিশমালা ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে ৬ মার্চ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে জানান আলী রিয়াজ।
তিনি বলেন, “প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো-সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো- 'একমত', 'একমত নই' এবং 'আংশিকভাবে একমত'। এ তিনটি বিকল্পের যে কোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
“দ্বিতীয়টি হল প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়। এই ক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে। সেগুলো হলো- ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে।
“এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোকে ‘মন্তব্য’ দেওয়ার জন্য জায়গা রাখা হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, “আমরা আশা করছি যে, আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো তাদের মতামত আমাদেরকে জানাবেন। ইতোমধ্যে যদি কোনও প্রশ্ন থাকে বা ব্যাখ্যার দরকার হয়, তবে কমিশন সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং এইসব বিষয়ে আলোচনা করতে সবসময় প্রস্তত আছে।”
আলী রীয়াজ জানান, গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নাগরিকদের মতামত জানতে চাওয়া হবে। এক্ষেত্রে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত চাওয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “অধ্যাদেশের মাধ্যমেও সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব, অতীতে বাংলাদেশে এটা হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি বাদে বাকি সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন- জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সেখানে ছিলেন।
‘একমত হতে সংখ্যা বিবেচ্য নয়’
কতটি দল ঐকমত্য হলে তাকে জাতীয় ঐকমত্য হিসেবে ধরা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “সংখ্যা বিবেচ্য বিষয় নয়। আমরা অবশ্যই অধিকাংশ দলের মতকে প্রাধান্য দেব। তবে আমরা আশা করছি প্রত্যেকটা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে ৩৪টি দলই একমত হবেন, সেটা হলে ভালো হবে। কাজটা সহজ হবে।”
তিনি জানান, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এবং শক্তির প্রভাব সমাজে আছে।
“তবে আমরা পূর্বনির্ধারিত ধারণা থেকে অগ্রসর হচ্ছি না। এগুলোর গুরুত্বকে বিবেচনা করছি। আমরা শুধু টিক চিহ্নের ওপর নির্ভর করছি না, আলাপ-আলোচনা করব। আলোচনার মাধ্যমে অনেক বিষয়ে একমত হতে পারব বলে আশা করছি। সেক্ষেত্রে সংখ্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোকে মতৈক্যে আনতে পারি সেটাই আমাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয় হবে।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চায় জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো যদি কালকেই সব বিষয়ে একমত হন, তাহলে পরশু দিনের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ করে ফেলব।”
নির্বাচনি প্রক্রিয়া ‘বাধাগ্রস্ত হবে না’
এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচন ও সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে ‘বিরোধ নেই’।
“নির্বাচনের জন্য টাইম-টেবিল তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। ডিসেম্বর মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে। আশা করছি এ ব্যাপারে খুব শিগগিরই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আসবে।
“জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজের কারণে নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধা-বিঘ্ন হওয়ার কারণ দেখি না। নির্বাচনের প্রস্তুতি নির্বাচন কমিশন ও সরকার নেবে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ঐকমত্য তৈরি করার চেষ্টা করা।”
তিনি বলেন, “এটা কেবল আগামীকালের বিষয় নয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে দীর্ঘদিন যাবত। বড় রকমের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
“অনেক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে এখানে এসেছি। এটা ভবিষ্যত বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাঠামো মনে করছি। ফলে আগামীকাল নির্বাচনের বিবেচনার চেয়ে, সবচেয়ে বড় বিবেচনা হচ্ছে বাংলাদেশ কোন পথে অগ্রসর হবে তার একটা দিকনির্দেশনা। এটা সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। আর জাতীয় সনদ বাংলাদেশের ভবিষ্যত পথরেখা নির্দেশ করবে। ফলে এটার সঙ্গে অবিলম্বে নির্বাচনের বিরোধ দেখতে পাই না।”
অধ্যাদেশের সংশোধন ‘সম্ভব’
সংবিধান অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধন করার সুযোগ আছে কিনা— এমন প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেন, “অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করা যায়। এটা বাংলাদেশে হয়েছে। ফলে এটা নিয়ে একমত, দ্বিমত হতে পারে।
“বাংলাদেশে অতীতে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনী হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। ফলে এটা হয়েছে, এটা সম্ভব। কিন্তু সেটাই একমাত্র বিবেচনা আমাদের ছিল না। কারণ আমরা কোন কিছুই এজেন্ডা সেট আমরা করছি না।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গণপরিষদ নির্বাচনের দাবির বিষয়টি তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, “এর বাইরেও অনেক রাজনৈতিক শক্তি ও দল গণপরিষদের কথা অতীতে বলেছে। কেবল মাত্র ৫ অগাস্ট পরবর্তী নয়, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবত যারা সংবিধান নিয়ে আলোচনা করে, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে, তারা গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের কথা বলেছেন। আমরা রাজনৈতিক দলের কাছে প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করেছি, তারা মতামত দিক, তারপর আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব।”
বিএনপি সংস্কার প্রক্রিয়ায় একমত না হলে বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা– এমন প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেন, “সংখ্যাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় না কিন্তু সংখ্যা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে দুটো বিষয়কে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমাদের একজায়গায় এসে জাতীয় সনদ তৈরি করতে হবে। যা বর্তমান কাঠামো পরিবর্তনে সহায়ক হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথরেখা তৈরি হবে।”
রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি নাগরিকদের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানান আলী রীয়াজ।
আপাতত দল ছাড়া অন্য কারো সাথে আলোচনা নয়
রাজনৈতিক দলের বাইরে কারও সঙ্গে এ মুহূর্তে আলোচনা করবে না জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ মনে করেন, গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই সঙ্গে সম্ভব।
“যারা প্রথমে গণপরিষদের দায়িত্ব পালন করবে, পরবর্তীতে সময়ে জাতীয় সংসদ হিসেবে কাজ করবে। আবার পাশাপাশিও করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হলে এটা সম্ভব। ১৯৪৭ সালে ভারতের গণপরিষদ একইভাবে দেশও শাসন করেছিল। এই উপমহাদেশের কোনো ঘটনা আছে। তবে আমরা কোনো কাঠামো তৈরি করছি না।”
জাতীয় সনদের বিষয়ে তিনি বলেন, “প্রধান কাজ হচ্ছে কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত, সেগুলোকে সন্নিবেশিত করা। সকলের অঙ্গীকার নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক দলগুলো তারা যে যেখানেই থাকুক ক্ষমতায় যান অথবা বাইরে থাকুন তাদের দায়িত্ব হচ্ছে এগুলোকে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রচেষ্টা বা পদক্ষেপ নেওয়া।
“সেটা বাস্তবায়নের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গণভোটে দেওয়া যেতে পারে। কিংবা এর আলোকে সংবিধান ও অন্যান্য আইনের যে সমস্ত পরিবর্তন তার খসড়া তৈরি করে চুক্তি করতে পারে।”