দু-তিন বছরে নতুন সংখ্যা প্রকাশ করেনি- এমন স্টলই অর্ধেকের বেশি।
Published : 16 Feb 2023, 10:34 PM
বইমেলায় সৃজনশীল সাহিত্যিকদের আড্ডার একসময়ের প্রাণকেন্দ্র লিটলম্যাগ চত্বরে আর সেই জৌলুস নেই।
তবুও যেসব লিটলম্যাগ সৃজনশীল চিন্তার নানা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের গতিপথকে এগিয়ে নিচ্ছে, সেসবের সম্পাদকরা হতাশা প্রকাশ করেছেন মেলার আয়োজকদের ‘অবহেলা’ আর ‘অব্যবস্থাপনায়’।
তারা বলছেন, লিটলম্যাগ চত্বরকে অবহেলা করে বইমেলার আয়োজকেরা মানুষের কাছে এর আবেদন নষ্ট করছে। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাবে লিটলম্যাগ চত্বর এখন পাইরেটেড বই আর বাংলা বাজারের শিশুতোষ বাজারি বইয়ের বিক্রয় কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।
নতুন সংখ্যা নেই তবুও বেড়ে চলেছে লিটলম্যাগ চত্বরের স্টল। গেল বছর লিটলম্যাগ চত্বরে ১২৭টি স্টল থাকলেও এবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৫৪টি লিটলম্যাগের নামে।
যার মধ্যে অনেকেই বরাদ্দ পাওয়া স্টলে ব্যানারও টানায়নি। গত দু-তিন বছরে নতুন সংখ্যা প্রকাশ করেনি- এমন স্টলই অর্ধেকের বেশি। কিছু স্টলে ফুটপাতের মতো ডেকে ডেকে বই বিক্রি করতেও দেখা যাচ্ছে।
জাতীয় কবিতা পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক কবি শরাফত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা নিয়মিত লিটলম্যাগ চর্চা করে না, লিটলম্যাগ চত্বরে তাদের বরাদ্দ দেওয়া উচিত না। অনেক স্টল ফাঁকা রয়েছে, ব্যানারও নেই। এতে লিটলম্যাগ চত্বরের নান্দনিকতা নষ্ট হচ্ছে।"
লিটলম্যাগ চত্বরের সব স্টলে ঘুরে দেখা যায়, হাতে গোনা কিছু স্টলে রয়েছে নতুন সংখ্যা। কিছু মানসম্পন্ন লিটলম্যাগ নতুন সংখ্যা আনতে না পারলেও বিগত বছরের সংখ্যা রয়েছে তাদের স্টলে। আবার কেউ কেউ জানিয়েছে, তাদের নতুন সংখ্যা একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই মেলায় আসবে।
মেলার নীতিমালা অনুযায়ী নতুন সংখ্যা দেখাতে কিছু স্টল ফটোকপি করে কয়েকটি সংখ্যা বানিয়ে তা প্রদর্শন করছে। আর দাবি করছে, তাদের স্টলেও নতুন সংখ্যা রয়েছে।
থিয়েটার পত্রিকা ক্ষ্যাপার স্টলে কথা হয় পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক অপু মেহেদীর সাথে। তিনি বললেন, "যারা আবেগ নিয়ে পরিশ্রম করে লিটলম্যাগ চর্চা করছে, নতুন সংখ্যা প্রকাশ করছে- তারা হতাশ হচ্ছে।
“পাশের স্টলে যখন দেখা যায়- বাংলাবাজার বা নীলক্ষেতের ফুটপাতে ২০ টাকা করে বিক্রি করা বই এখানে ২০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, এতে বইপ্রেমীদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। যে পাঠক বই কিনে এখানে প্রতারিত হচ্ছেন, তারা হয়তো লিটলম্যাগ চত্বর নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পাচ্ছে।"
যারা নিয়মিত লিটলম্যাগ চর্চা করে না, তাদেরকে এ চত্বরে স্টল বরাদ্দ দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করে অপু মেহেদী।
তার কথায়, "যাচাই-বাছাই করে লিটলম্যাগকে এই চত্বরে বরাদ্দ দেওয়া হলে মান বজায় থাকবে। সেই সাথে এই চত্বরের ব্যবস্থাপনাও উন্নত করা উচিত। পহেলা ফাল্গুনের সন্ধ্যায়ও পুরো মেলায় দেখেছি আলো জ্বলেছিল, কিন্তু অজানা কারণে লিটলম্যাগ চত্বর ছিল পুরো দুই ঘণ্টা অন্ধকার।
‘এর আগে মেলা শুরুর দুই দিন পর এই চত্বরে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাও আয়োজকদের জানানোর পর। এই চত্বরটি নিয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির অবহেলার কারণেই আবেদন হারাচ্ছে বইমেলার লিটলম্যাগ চত্বর।"
লিটলম্যাগ চত্বরে এত স্টল কেন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে- প্রশ্ন রেখে দোলন সম্পাদক কামাল মোস্তফা বললেন, "এখানে যাদের স্টল দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই লিটলম্যাগ চর্চা করে না। আবার সারাদেশে নিবেদিত অনেক লিটলম্যাগ রয়েছে, যারা বইমেলায় আসে না। কারণ এক মাস ঢাকায় থেকে স্টল চালানোর মতো লোকবল বা আর্থিক সঙ্গতি হয়তো নেই।
“কারণ লিটলম্যাগ তো আর্থিকভাবে লাভজনক নয়। এতে করে সারা দেশের লিটলম্যাগের মূল চিত্র কিন্তু বইমেলায় পাওয়া যায় না। তাই যারা বিভিন্ন জেলা শহরে থেকে ভালো মানের লিটলম্যাগ প্রকাশ করছে, তাদের মেলায় যুক্ত করার জন্য প্রণোদনা বা উৎসাহ দেওয়া উচিত।"
প্রচ্ছদশিল্পী ও লিটলম্যাগকর্মী চারু পিন্টু বলেন, "লিটলম্যাগের যে মতাদর্শিক জায়গা- সেটি মেনে যারা চলেন, তাদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি স্টল লিটলম্যাগ চত্বরে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এতে বইপ্রেমীদের কাছে লিটলম্যাগ চত্বরটি এখন আর সেই আবেদন রাখতে পারছে না।"
লিটলম্যাগ চত্বরের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "লিটলম্যাগ চত্বরে পাইরেটেড বই বিক্রির যে অভিযোগ আছে, সেটি খতিয়ে দেখার জন্য আমি সংশ্লিষ্টদের বলব।
“লিটলম্যাগ চত্বর নিয়ে আমাদের দিক থেকে কোনো অবহেলা নেই। আমরাও চাই, এই চত্বরটি সৃজনশীল সাহিত্যের আড্ডায় মুখর থাকুক।"
নতুন সংখ্যা এনেছে যারা
জোসে প্রাপন সম্পাদিত 'শিং', কামাল মোস্তফা সম্পাদিত 'দোলন', এম এস ইসলাম আরজু সম্পাদিত 'কাব্যছন্দ', রনজু রাইম সম্পাদিত 'সংক্রান্তি' (কামাল চৌধুরী কবিতার বরপুত্র), পাভেল রহমান সম্পাদিত থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা 'ক্ষ্যাপা', রিসি দলাই সম্পাদিত 'সরলরেখা', ইসমত শিল্পী সম্পাদিত 'নান্দিক', শফিক আজিজ সম্পাদিত 'কার্পাস' (শনাক্ত কবিতা সংখ্যা), আবু এম ইউসুফ সম্পাদিত 'অনুপ্রাণন', জালাল খান ইউসুফী সম্পাদিত 'কাব্যকথা', আনোয়ার কামাল সম্পাদিত 'এবং মানুষ' (উৎসব সংখ্যা), এজহারুল ইসলাম সম্পাদিত 'গোল্লাছুট', আইরিন আক্তার সম্পাদিত 'ফড়িং', বিমল সরকার সম্পাদিত 'কালের চিঠি', হুমায়ুন কবির সম্পাদিত 'ঘুঙুর', বাদল শাহ আলম সম্পাদিত 'খনন', কাজী মামুন হায়দার সম্পাদিত 'ম্যাজিক লণ্ঠন', আশরাফ জুয়েল সম্পাদিত 'পূর্ব পশ্চিম', হোসেন দেলওয়ার সম্পাদিত 'দূরের সাইকেল (কবি জুয়েল মাজহাল সংখ্যা)', মামুন মুস্তাফা সম্পাদিত 'লেখমালা', র আ ম উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী সম্পাদিত 'মত ও পথ', তৈমুর রহমান মৃধা সম্পাদিত 'ডাহুক', মাহমুদ হাফিজ সম্পাদিত 'ভ্রমণগদ্য', সাহেদ বিপ্লব সম্পাদিত 'ডাকপত্র', আল মুজাহিদী সম্পাদিত 'নতুন এক মাত্রা', রবু শেঠ সম্পাদিত 'পুনশ্চ', খালেক উদ-দীন সম্পাদিত 'বুনন', আবদুল্লাহ-আল-অলিদ সম্পাদিত 'নব ভাবনা' (ভ্রমণ সংখ্যা)।
এছাড়া দ্রষ্টব্য, নোঙর, অনুরণন, পূর্বাপর, ছোটদের সময়, কথার স্টলের কর্মীরা জানিয়েছে, তাদের নতুন সংখ্যা একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই মেলায় আসবে।
নানা অনুষ্ঠান
বৃহস্পতিবার মেলার ষোড়শ দিনে নতুন বই এসেছে ৮৩টি।
বিকাল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।
প্রাবন্ধিক ফরিদ আহমদ দুলাল বলেন, “দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে অর্থবহ করে তোলা যেমন জরুরি, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনে সাংস্কৃতিক মুক্তি নিশ্চিত করাটাও অপরিহার্য।
“সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের সকল স্তরে সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে সমন্বয় করতে হবে। দেশের মাঠপর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়, কখনও কখনও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নটি এবং সেখানেই বাংলা, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণের সৌন্দর্য লুক্কায়িত।”
অনীক মাহমুদ বলেন, "জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে জাতির মূল শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিই একটি জাতির মূল শক্তি। সাংস্কৃতিক চর্চাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের মানুষদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব।"
আলোচনায় অংশ নেন মাহমুদ কামাল, নজিবুল ইসলাম ও সাজ্জাদ আহসান।
এ দিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন ইসরাইল খান, মাসুম রেজা, রিপন আহসান ঋতু ও জুনান নাশিত।
সন্ধ্যায় মূল মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন আমিনুর রহমান সুলতান, আয়শা ঝর্না, শিহাব শাহরিয়ার, অংকিতা আহমেদ রুবি, ফরিদুজ্জামান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী সৈয়দ শহীদুল ইসলাম, জেসমিন বন্যা, নূরুননবী শান্ত। এছাড়া ছিল সিরাজুল মোস্তফার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মাইজভান্ডারী মরমী গোষ্ঠী’ এবং আনোয়ার হোসেনের পরিচালনায় ‘আরশিনগর বাউল সংঘ’র পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন ফরিদা পারভীন, সেলিম চৌধুরী, সাধিকা সৃজনী তানিয়া, শ্যামল কুমার পাল, সনৎ কুমার বিশ্বাস, মেহেরুন আশরাফ, বাবু সরকার ও মো. আরিফুর রহমান। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন চন্দন দত্ত (তবলা), রবিন্স চৌধুরী (কি-বোর্ড), গাজী আব্দুল হাকিম (বাঁশি), শেখ জালাল উদ্দীন (সেতার)।
শুক্রবার যা থাকছে
ছুটির দিন শুক্রবার মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলবে শিশুপ্রহর। এ দিন সকাল ১০টায় মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
বিকাল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মহীবুল আজিজ। আলোচনায় অংশ নেবেন অনিরুদ্ধ কাহালি ও মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন। সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ আকরম হোসেন।