সুদান থেকে সব বাংলাদেশিকে চলে আসার আহ্বান

খার্তুমের যে স্থান থেকে বাসে তোলার পরিকল্পনা হয়েছে, ওই এলাকাটিতে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকছে বলে প্রবাসীরা জানিয়েছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2023, 03:02 PM
Updated : 30 April 2023, 03:02 PM

সংঘাতময় সুদান থেকে বাংলাদেশি সবাইকে চলে আসার পরামর্শ দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করার পর রোববার ঢাকায় এক বৈঠকের পর এই আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে বাংলাদেশিদের ফেরাতে খার্তুমের যে স্থান থেকে তাদের বাসে তোলার পরিকল্পনা হয়েছে, ওই এলকাটিতে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকছে বলে ফিরতে ইচ্ছুক প্রবাসীরা জানিয়েছেন।

তবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আশ্বস্ত করছেন, সংঘাতের মধ্যেও যতদূর সম্ভব নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই আফ্রিকার ওই দেশ থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা হবে।

গত ১৫ এপ্রিলে সুদানে সশস্ত্র বাহিনী এসএএফ ও আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফের লড়াই শুরুর পর কয়েকশ মানুষ নিহত হয়েছে। এ লড়াইয়ে রাজধানী খার্তুম ও আশপাশের আবাসিক এলাকাগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

সুদানে দেড় হাজারের মতো বাংলাদেশি রয়েছে। পরিস্থিতির ক্রম অবনতি ঘটায় বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাদের সুদান থেকে জাহাজে সৌদি আরবের জেদ্দায় নিয়ে সেখান থেকে ফেরানো হবে।

ফিরতে ইচ্ছুক প্রায় ৭০০’ বাংলাদেশি মঙ্গলবার খার্তুম থেকে রওনা করবেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার।

তিনি রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী পরশু দিন খার্তুমের উপশহরের একটি জায়গা থেকে পোর্ট সুদানের উদ্দেশ্যে বাসে করে রওনা হবেন ।

“পোর্ট সুদানে পৌঁছানোর পরে জেদ্দা পোর্টের উদ্দেশে রওনা দেবেন। সেটি হবে সৌদি একটি জাহাজে, সেখানে একাধিক জাহাজ আছে, ছোট বড় বিভিন্ন আকারে।”

এদিকে,খার্তুমের শারিয়া আল সিত্তিন ও মাদানি স্ট্রিটের যে চৌরাস্তায় বাসে উঠার জন্য জড়ো হতে বলা হচ্ছে, সেই জায়গাটি ‘নিরাপদ বলে মনে করছেন না প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

সুদান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনিসুর রহমান বলেন, “ওই জায়গায় বাস আসবে ৪টার সময় আর ছাড়বে ৫টার সময়।

“কেউ যদি মনে করে, সে রিস্ক নেবে, সে রিস্ক নিয়ে যেতে পারে. সেটা তার ভাগ্য। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ না। আরেকটা বিষয়, এর পাশেই হলো আরএসএফের ঘাঁটি।”

এর আগে আরএসএফের বাধার কারণে ৪ ঘণ্টা ভারতীয় নাগরিকদের বাস আটকে ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “ইন্ডিয়ানদের গাড়ি হোটেল রোটানাতে জায়গা না পেয়ে এই জায়গা থেকে দিছিল, এখান থেকে যখন ছেড়ে যায়, আরএসএফ তাদেরকে ঘিরে ফেলে। গাড়ি খালি করে সমস্ত লোকজনকে নামিয়ে দিয়েছে।

“বলছে, এই জায়গা দিয়ে যেতে পারবা না। এ কারণে তারা টেলিফোনে যোগাযোগ করে বিভিন্ন জায়গায় শেল্টার নেই, পরে তাদেরক পিক করে ৯টার সময় ছাড়ে।”

আনিস জানান, যে স্থান থেকে বাংলাদেশিদের বাস ছাড়ার কথা, সেখান থেকে ৫ কিলোমিটারের মতো দূরে হোটেল রোটানায় অবস্থান করে অনেক বিদেশি নাগরিক খার্তুম ছেড়েছিলেন। এখন হোটেল রোটানা ফাঁকা আছে চাইলে সেখানে অবস্থান করা যাবে।

“রোটানা এখন ফ্রি আছে, তোমরা যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারো। আমাদের একজন বাংলাদেশি এখন অবস্থান করছে। সে বলছে, হলরুম মোটামুটি ফ্রি আছে। কারণ, বাংলাদেশ আর দুয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় সব দেশের লোকজন চলে গেছে।”

প্রবাসীদের এই উদ্বেগের বিষয়ে এক প্রশ্নে শাহরিয়ার বলেন, “এটা আমাদেরও নজরে এসেছে। দুটো বিষয়, যারা গ্রাউন্ডে আছেন, তাদের মতামতটি খুবই জরুরি। এবং সেই সাথে সাথে যে বাস কোম্পানি আছে এবং অন্যান্য যেসব দেশ সহযোগিতা করছেন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে… এবং পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে।

“আজকে যেটাকে সঠিক মনে হচ্ছে, পরশু দিন তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। তো, আমরা নজর রাখব। নিরাপদ স্থান থেকেই তাদেরকে বাসে উঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

Also Read: সুদান থেকে নাগরিকদের সরিয়ে নিতে তোড়জোড় বিভিন্ন দেশের

Also Read: সুদান থেকে ফেরানো হবে বাংলাদেশিদের: পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

Also Read: সুদানে আটকে পড়া ‘৭০০ প্রবাসী’ ফিরবেন জেদ্দা হয়ে: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

Also Read: সুদানে সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়েছে, বাড়ছে লড়াই

Also Read: সুদানে আক্রান্ত হয়েও যেভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ দূতাবাস

আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি বাসে উঠার আগ পর্যন্ত যদি অপেক্ষার বিষয় থাকে, বাস স্ট্যান্ডে এসে বা আসতে ওইটুকু করার পরে বাসে ওঠার পর পুরোপুরি আমাদের দায়িত্ব। সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি।

“বাসে জার্নি আছে প্রায় ৭-৮শ কিলোমিটারের। যারা এসেছেন, জাহাজেও তাদের একটু সমস্যা হয়েছিল, এগুলো যেন না হয়, সেজন্য আমাদের খার্তুম দূতাবাসের শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আছেন, তিনি ইতোমধ্যে বন্দোবস্ত করেছেন।”

পোর্ট সুদানে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাবার এবং অর্থও দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশিদের উদ্ধারের পরিকল্পনা তুলে ধরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “যাদের কাছে পাসপোর্ট আছে, তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে উঠিয়ে নেওয়া এবং যাদের কাছে প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট নেই, তাদেরকে ট্রাভেল পারমিটটি দ্রুততার সঙ্গে দিয়ে দিয়ে পরবর্তী নেক্সট অ্যাভেইলেভল ভেসেলে করে পাঠানো।”

তিনি বলেন, “সব দেশ ইভাকুয়েশন শুরু করেছে এটাও কিন্তু ঠিক নয়। আবার কিছু বাঙালি চলেও এসেছেন, নিজেদের মতো করে যতজন এসেছেন।

“খার্তুমের বিমানবন্দরে অন্য একটি রাষ্ট্রের বিমানেও হামলা হয়েছে এবং সেটি আরেকটি পশ্চিমা রাষ্ট্র কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিল যাবার পরে, তারাও কিন্তু সেখানে ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন অনেকটাই। সেই সাথে সাথে তারা কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ইভাকুয়েট করেছেন, সাধারণ মানুষকে নয়। আমাদের সরকারি কর্মকর্তা কেউ যাননি চলে, সকলে থেকে গেছেন।”

সংঘাতের মধ্যে খার্তুমে বাংলাদেশ দূতাবাসও আক্রান্ত হয়েছে। দূতাবাসের কর্মকর্তারা ঝুঁকি নিয়েই প্রত্যাবাসনের কাজটি করছেন।

বাংলাদেশিদের নিরাপত্তার জন্য সুদানের বিবাদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে শাহরিয়ার বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছি।

“এই রকম কোনো মেকানিজম নেই। কারণ, তারা যুদ্ধের মধ্যে। এটা আপনাদের কাছেও একটু অবাক করার মতো লাগতে পারে, এতে কোনো আর্লি ইন্ডিকেশন ছিল না। যে সিজফায়ারটি হচ্ছে, সেটিও কিন্তু সব জায়গায় পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।”

থেকে গেলে বিপদ

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশিদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৭০০ জন ফিরতে নিবন্ধন করেছেন।

তিনি বলেন, “যারা রেজিস্ট্রেশন করেননি, তাদেরকে বলব, এটি নিরাপদ নয়। তারা কোনো যুক্তিতে হয়ত সেখানে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এবং অন্য কোনো প্রচেষ্টা করবেন।

“সেখান থেকে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রে যাওয়া কিন্তু ইউক্রেইনের মতো সহজ হবে না। খার্তুম থেকে বের হলেই কিন্তু উত্তরে বলেন, পশ্চিমে বলেন মরুভূমি। খুবই কঠিন জায়গা।”

সরকার যেহেতু সহযোগিতা করছে, তাই নিরাপত্তার স্বার্থে সব বাংলাদেশিকে ফিরে আসার আহ্বান জানান তিনি।

এখনও যারা নিবন্ধন করেননি, তাদের দ্রুত নিবন্ধন করার আহ্বান জানিয়ে শাহরিয়ার বলেন, “আমাদের খার্তুম দূতাবাসের যে নম্বরগুলি আছে সেখানে, অথবা ইথিপিওয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতে, সৌদি আরবে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের যে দপ্তরগুলো আছে সেখানে যোগাযোগ করতে পারেন।

“আমরা যে কোনো জায়গা থেকে তথ্যটি পেলে সেটি নিয়ে আপনাদেরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।”

প্রবাসীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দেরিতে শুরু করা হল কি না- এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমার মনে হয় না। আমরা আর্লিয়েস্ট পসিবল টাইমেই রিঅ্যাক্ট করেছি।”

বাংলাদেশিরা ফিরে আসার পর দূতাবাসের কর্মকর্তারা ফিরে আসবে কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটা সময় বলবে। কিন্তু খার্তুমে ফেরার পরিবেশ এখন নেই।

“পোর্ট সুদানে বসে আরও যদি একশ-দুশ জনকে যদি পরবর্তীতে আকৃষ্ট করা যায়, বোঝানো যায়, সে সময় পর্যন্ত থাকবেন। সর্বশেষ বাংলাদেশি সুদানে থাকা পর্যন্ত আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা করব।”

জেদ্দায় আসার পর ব্যবস্থা

পোর্ট সুদান থেকে জাহাজে জেদ্দায় পৌঁছানোর পর বাংলাদেশ বিমানের নিয়মিত ফ্লাইটেই সুদান প্রত্যাগতদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার। তিনি বলেন, প্রয়োজনে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করার প্রস্তুতিও রাখছে সরকার।

“মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক শহর থেকে বিমানের খুব নিয়মিত সেবা আছে। সে সার্ভিসে তারা আসতে পারবেন। কোনো বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করার থাকলে সেটারও প্রস্তুতি আছে।”

তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি ২ বা ৩ তারিখে প্রথম লট যারা আসবেন পোর্ট সুদানে, তার একদিনের পর থেকে তাদেরকে নিয়ে আসতে পারব।”

পের্ট সুদান থেকে প্রায় ১২ ঘণ্টার নৌযাত্রায় লোহিত সাগর পেরিয়ে জেদ্দা পৌঁছতে হবে।

শুরুতে জেদ্দার স্কুলে প্রবাসীদের রাখার পরিকল্পনা করা হলেও সৌদি কর্তৃপক্ষ এখন তাদেরকে হোটেলে রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছে বলে জানান শাহরিয়ার।

তিনি বলেন, “আশা করছি, আমরা কার্যক্রমটি আগামী ৪৮ ঘণ্চটার মধ্যে শুরু করতে পারব।। যেহেতু খার্তুম দূতাবাসে কাজ করার মতো পরিবেশ নেই, আমাদের জেদ্দা দূতাবাস থেকেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টাকা-পয়সাসহ আমরা কিন্তু পাঠিয়েছি।”

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ফেরত আসা প্রবাসীদের একটি ডেটাবেইজ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হবে, যাতে ‘অসময়ে কর্ম হারিয়ে ফেলা’ প্রবাসীদের বাংলাদেশে কাজে যুক্ত করার জন্য সহযোগিতা করা যায়।