Published : 04 May 2025, 08:15 PM
রাখাইনে জরুরি ত্রাণ সহায়তা পাঠাতে মানবিক করিডোর নিয়ে বিতর্ক ও বিরোধিতার মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের প্রক্সি যুদ্ধে জড়াবে না বাংলাদেশ।
রোববার ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক এক সেমিনারে এ কথা বলেন তিনি।
নিরাপত্তা উপদেষ্টার পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সংকট ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের দায়িত্বে থাকা খলিলুর বলেন, “আমরা যদি আমেরিকার পক্ষে প্রক্সি যুদ্ধ করতামও, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হত কে? চীন। তাহলে চীন কিছু বলছে না কেন?
“কেন অন্য একটা স্থান থেকে অপতথ্য আসছে? যেভাবে আমরা বাংলায় একটা কথা বলি, ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশ,” ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন তিনি।
২০২১ সাল থেকে সামরিক জান্তা সরকারের বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের গৃহযুদ্ধে বিপর্যপ্ত বাংলাদেশের পূর্বের প্রতিবেশী মিয়ানমার। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের লাগোয়া রাখাইন রাজ্যের পুরোটা দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। শুধু এ রাজ্যের কায়ুকফায়ু সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছে সামরিক জান্তা।
রাখাইনে যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে গত নভেম্বরে ‘রাখাইন: গড়ে উঠছে একটি দুর্ভিক্ষ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আসন্ন দুর্ভিক্ষের হুমকিতে রাখাইন। অনুমান হচ্ছে, ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিলে স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন কেবল ২০ শতাংশ মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারবে। বীজ ও সারের অভাব, বাজে আবহাওয়া এবং বাস্তুচ্যুতির কারণে মানুষ কৃষি কাজ থেকে দূরে থাকায় ধান উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বাণিজ্য প্রায় বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারে থাকার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। তবে, রাখাইনের প্রবেশপথের পাশাপাশি একমাত্র সমুদ্রবন্দরটি দখলে আছে মিয়ানমার জান্তা সরকারের। এর ফলে রাখাইনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পণ্যে ঢোকার পথ বন্ধ।
এর মধ্যে মানুষের আর্থিক সংকট এবং ব্যাপক মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি উপার্জন আর স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকমাত্রায় কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কথা বলা হয় ওই প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ঢাকা সফরের পর গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের ‘মানবিক সহায়তা চ্যানেল’ বিষয়ে প্রথম ধারণা দেন খলিলুর রহমান।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেলে’ বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রথম আসার কথা তুলে ধরে ওইদিন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, আরাকান আর্মি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিয়ানমার সরকার- সবার সঙ্গে আলোচনা করেই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে গিয়েছিলেন তিনি।
“তাকে আমরা বলেছি, রাখাইনে যে মানবিক সমস্যা, যে সংকট সেটা মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের বিকল্প নাই। সেই কাজটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই হবে।”
তার ওই বক্তব্যের প্রায় তিন সপ্তাহ পর গত রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘মানবিক প্যাসেজ’ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি এটুকু আপনাদেরকে বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এটাতে সম্মত। কারণ, মানবিক প্যাসেজ হবে। কিন্তু এটাতে আমাদের কিছু শর্ত আছে, সেটার বিস্তারিততে যাচ্ছি না, সেই শর্তাবলী যদি পালিত হয়, আমরা এটাতে অবশ্যই সহযোগিতা করব, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অবশ্যই।”
তার ওই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে রাজনৈতিক দলগুলো।
‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের ‘নীতিগত সিদ্ধান্তে’ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদের কাছ থেকে।
রাজনৈতিক দলগুলোর এমন বিরোধিতার মুখে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ’ বা ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়া নিয়ে ‘জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার’ সঙ্গে সরকারের কোনো আলোচনা হয়নি।
এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ যৌক্তিক পরিকাঠামোগত সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে।”
এমন প্রেক্ষাপটে বুধবার এক বার্তায় রাখাইনে মানবিক সহায়তা নেওয়ার পথ তৈরির ক্ষেত্রে জাতিসংঘ যদি জড়িত হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হওয়ার কথা বলেছে বৈশ্বিক সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়।
এরপর প্রেস সচিব শফিকুল আলম শুক্রবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেন, “মানবিক করিডোরে আমরা রাজি যদি জাতিসংঘ এটার উদ্যোগ নেয়। এই পুরো জিনিসটা হবে দুইটা দেশের সাথে কথা বলে। জাতিসংঘ যখন কাজ করে তারা সেখানে সংশ্লিষ্টদের সাথে অর্থাৎ মিয়ানমার সরকারের সাথেও কথা বলবে, আমাদের সাথেও কথা বলবে। বলে তারপরই তো সিদ্ধান্তে আসবে।”
‘মানবিক করিডোর’ করার প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারে ‘প্রক্সি’ যুদ্ধে বাংলাদেশ জড়িয়ে যাচ্ছে কি-না, সে সন্দেহ প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধও বেশ প্রচার পেয়েছে।
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাকে ‘গুজব ও অপতথ্য’ হিসেবে উড়িয়ে দেন সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পাওয়া খলিলুর রহমান।
মিয়ানমারের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি বাংলাদেশের শ্রদ্ধাবোধ অব্যাহত থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি আমার আগের আলোচনায় যেভাবে বলেছি, সেটা এখনও অব্যাহত আছে।
“আমরা মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাকে সমর্থন করি না এবং আমরা তোমাদের ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে শ্রদ্ধা করি।”
মানবিক করিডোর নিয়ে কোনো ‘আলোচনা না হওয়ার’ কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা মানবিক করিডোর নিয়ে আলোচনা করিনি। মানবিক করিডোর নিয়ে আমাদের কোনো চুক্তি হয়নি। কোনো পক্ষের সঙ্গেই এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি।”
মিয়ানমারের ত্রাণ পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ে কোন পর্যায়ে আছে, নিজের আগের সংবাদ সম্মেলনে সেটি খোলাসা করা হয়েছে বলে জানান খলিলুর রহমান।