শনিবার ঢাকার চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বর্ষা উৎসব আয়োজন করে জাতীয় বর্ষ উৎসব উদযাপন পরিষদ।
Published : 15 Jun 2024, 12:52 PM
দমকা হওয়ার শনশন, গাছগাছালির পাতায় পাতায় ঝোড়ো হাওয়া বা টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ বর্ষার নিজস্ব সুর। এই ঋতুর সূচনায় এসব কিছুর দেখা না মিললেও মেঘলা দিনে ধরিত্রীকে সবুজ করার লক্ষ্য নিয়ে গান-নাচ-আবৃত্তি ও আলোচনায় আষাঢ়ের প্রথম দিন বরণ করা হল নগরে।
শনিবার ঢাকার চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বর্ষা উৎসব আয়োজন করে জাতীয় বর্ষা উৎসব উদযাপন পরিষদ। বংশীবাদক মো. হাসান আলীর বাঁশি বাদনে যে উৎসব হয় সুরেলা।
পরে একে একে বর্ষার গান গেয়ে শোনান শিল্পীরা। কবিতার পংক্তি বাঙময় হয় আবৃত্তিতে, আর নাচের ঝংকারে অনুষ্ঠান মুখরিত করে তোলেন নৃত্যশিল্পীরা। এছাড়াও অনুষ্ঠান মঞ্চে শিশু-কিশোরদের মাঝে বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা বিতরণ করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে চিত্রশিল্পী অধ্যাপক আবুল বারাক আলভী বলেন, “তীব্র বৈশাখের পর যখন বর্ষা আসে, তখন সবাই শান্তি অনুভব করে। আর এই বর্ষার সাথে কৃষির একটা সম্পর্ক আছে। ভালো ফসল হবে কি না, তা বর্ষার সাথে সম্পর্কিত। এজন্য আমাদের কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় বর্ষা ঋতু বেশ গুরুত্ব বহন করে। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বর্ষা বন্দনা করার যে আয়োজন, তা তরুণদের প্রকৃতিপ্রেমে অনুপ্রাণিত করবে।”
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত রাখতে হলে এ ধরণের উৎসবের আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে বলে জানান বর্ষা উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।
“কারণ এ ধরনের অনুষ্ঠানে ধর্ম বর্ণ সকলের উৎসব। অসাম্প্রদায়িক আয়োজনের মধ্য দিয়েই মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়বে।”
বুড়িগঙ্গা নদীর প্রাণ ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ও প্যানেল মেয়র শহীদুল্লাহ মিনু বলেন, “আমরা যারা পুরান ঢাকায় বড় হয়েছিল, তারা দেখেছি বুড়িগঙ্গার সেই যৌবন। আমরা খেলার পর বুড়িগঙ্গায় গিয়ে গোসল করতাম। এখন বুড়িগঙ্গার পানি নষ্ট হয়েছে, আমরাই এর জন্য দায়ী। সিটি করপোরেশন থেকে আমরা কিছু পরিকল্পনা করেছি, যাতে বুড়িগঙ্গার পানি আবার প্রাণ ফিরে পায়। তার বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে।”
বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি গোলাম মোস্তফা।
তিনি বলেন, “আমরা যুক্তরাজ্যেও বাঙালি সংস্কৃতির নানা আয়োজন নিয়মিত করি। বৈশাখী মেলা হয়, বইমেলা হয়। আমরা সেখানে শহীদ মিনার করেছি। সেখানে মেইনস্ট্রিম যত উৎসব হয়, সেখানেও আমরা অংশগ্রহণ করে বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরি।”
পরিষদের সভাপতির বক্তব্যে নিগার চৌধুরী বলেন, “বর্ষার অপেক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ, অসংখ্য খাল-বিল-নদী ভরে উঠে নতুন জলের স্বচ্ছধারায় ও বৃক্ষেরা পায় নবজীবন। আমাদের উচিত প্রকৃতিকে ভালোবাসা। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃতিকে ভালোবাসার কথা বলি। আজকের এই আয়োজনে আমরা গাছ লাগানোর আহ্বান জানাচ্ছি। সবাই যেন এই বর্ষায় গাছ লাগান।”
উৎসবে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন সাজেদ আকবর, সালমা আকবর, আবু বকর সিদ্দিক, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি, অনিমা রায়, তানভীর সজিব, ফেরদৌসী কাকলি, রত্না সরকার, শ্রাবণী গুহ রায়, এস.এম মেজবাহ, নবনীতা জাইদ চৌধুরী, স্নিগ্ধা অধিকারী, আরিফ রহমান, আবিদা রহমান সেতু, আকাশ মিত্র ও রোমানা আক্তার।
একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলি। বর্ষা ঋতুর লেখা থেকে পাঠ করেন ত্রপা মজুমদার।
দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন ওয়ার্দা রিহাবের পরিচালনায় ধৃতি নর্তনালয়, অনিক বসুর পরিচালনায় স্পন্দন, ফারহানা চৌধুরী বেবীর পরিচালনায় বুলবুল ললিতকলা একাডেমি অব ফাইন আর্টস, সাজু আহমেদের পরিচালনায় কত্থক নৃত্য সম্প্রদায়।
দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে সুরবিহার, সীমান্ত খেলাঘর আসর, বহ্নিশিখা, পঞ্চভাস্কর, নির্ঝরণী, সুরনন্দন, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে ঢাকা স্বরকল্পন।
প্রাণ- প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান উদীচীর
প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে প্রকল্প বা স্থাপনা গড়ে তোলার বিরুদ্ধে বার্তা দিয়ে ‘বর্ষা উৎসব’ করেছে উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ।
সকালে ঢাকার বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে এ উৎসব আয়োজন করা হয়।
উৎসবে উদীচীর তুলে ধরা কয়েকটি দাবি হল-অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে। শহরে-বন্দরে সৌন্দর্য বর্ধনের নামে গাছ কাটা, পশু-পাখির আবাসস্থল ধ্বংস করা চলবে না। অবিলম্বে দেশের বিলুপ্ত প্রায় পশু-পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
'প্রাণ- প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বিশ্ব বিবেক' এই স্লোগান নিয়ে সংগীতশিল্পী পন্ডিত অসিত কুমার দে’র রাগ সংগীতের মধ্যদিয়ে বর্ষা উৎসবের সূচনা হয়। এর পর সমবেত গান, আবৃত্তি, নৃত্য পরিবেশন করেন ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। পাশাপাশি ছিল আমন্ত্রিত শিল্পীদের গান, নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশনা।
উৎসবে নজরুল গীতি পরিবেশন করেন নাহিয়ান দুরদানা সুচি। একক আবৃত্তি করেন ডালিয়া আহমেদ। রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন সেমন্তী মঞ্জুরি। একক আবৃত্তি করেন আতিকুজ্জামান মির্জা। এ ছাড়া একক সংগীত পরিবেশন করেন মায়েশা সুলতানা উর্বি, অবিনাশ বাউল, রবিউল হাসান ও বর্ষাবন্দনা পরিবেশন করে উদীচীর শিল্পীরা।
ঢাকা মহানগর উদীচীর সভাপতি নিবাস দে’র সভাপতিত্বে বর্ষা কথনপর্বে কৃষি গবেষক রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা বলেন, " প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে যে উন্নয়নের ধ্বজা উড়ানো হচ্ছে সেটি আসলে কার উন্নয়ন? কথিত এ ‘উন্নয়ন’ কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে? বাংলাদেশের বর্তমান ‘উন্নয়নযাত্রা’র এ মডেলের সুবিধাভোগী মূলত একচেটিয়া করপোরেট প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতিবাজ দখলদার ব্যক্তি ও লুটেরা গোষ্ঠী। আর এর শিকার দেশের প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। দেশের সম্পদ নদীনালা, খালবিল, বন-পাহাড়, উন্মুক্ত জমি লুটেরা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে উন্নয়নের ধুয়া তুলে। এর মধ্য দিয়ে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর পুঁজির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজটি নিশ্চিত করেছে রাষ্ট্র।"
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের বরাত দিয়ে উদীচী জানায়, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় চার লাখ ৯৪ হাজার ২১১ একর। এই বিশাল এলাকার গাছগাছালি ধ্বংস না হলে ৭৩.৪ মেগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঠেকানো যেত। দেশে বন বিভাগের মোট জমি ৩৭ লাখ ৭১ হাজার ১২৪ একর।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি ও বর্ষা উৎসব উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক হাবিবুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে । ‘বর্ষাকথন' উপস্থাপন করেন কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলির সদস্য কবি রহমান মুফিজ। সঞ্চালনা করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক আরিফ নূর।