৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছিলেন বলে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে আঁচল ফাউন্ডেশন।
Published : 08 Oct 2022, 04:46 PM
কোভিড মহামারী পরবর্তী সময়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৭৫ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, যে সমস্যা থেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন তাদের অনেকে। এমন দাবি করল আঁচল ফাউন্ডেশন।
এক সীমাক্ষা চালিয়ে এমন ফল পাওয়া গেছে বলে সংগঠনটি জানিয়েছে। দেশের বিভিন্ন পাবলিক, বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা ১ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থীর উপর সমীক্ষা চালিয়ে তারা দেখতে পেয়েছে, ৩৪ দশমিক ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা সংক্রান্ত সমস্যা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছিলেন।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া কোভিড মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজট ও পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে হতাশাকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।
এছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিক চাপেও পড়াশোনায় অনীহা তৈরি, অভিভাবকদের চাপ, কোভিডে মনস্তাত্বিক পরিবর্তনকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শনিবার ‘করোনা পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর একাডেমিক চাপের প্রভাব এবং তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা’ শিরোনামে শিরোনামে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই সমীক্ষার প্রতিবেদন তুলে ধরে আঁচল।
সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক আব্দুল ওহাব।
জরিপে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার মোট ১ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়।
শিক্ষার্থীদের ৭৫ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন
আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা মাথায় এসেছে ৩৪.১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন ২.৪৪ শতাংশ
আত্মহত্যার উপকরণ যোগাড় করেও শেষ মুহুর্তে পিছিয়ে এসেছেন ৪.৭৬ শতাংশ
বেড়েছে ভয় ও আশঙ্কা
জরিপে মানসিক সুস্থতা বিষয়কবেশ কয়েকটি নিয়ামক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে উত্তরে আসে ‘উদ্বেগজনক’ কিছু তথ্য। মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫৭.৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন কোভিড মহামিারী পরবর্তী সময়ে তাদের নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগে তারা জর্জরিত।
পাশাপাশি দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও ব্যবহারে পরিবর্তনও এসেছে শিক্ষার্থীদের জীবনে। যেমন, মন খারাপ হওয়া, হঠাৎ ক্লান্তিসহ নানা বিষয় তাদের শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলেছে বলে জানায় ৮০.৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী।
ডিজিটাল আসক্তিতে মানসিক সমস্যা
দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অংশ হয়ে যাওয়া ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর মধ্যে মোবাইল, ল্যাপটপ, ডেস্কটপের উপরে অতিরিক্ত আসক্তি ও নির্ভরতা শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন ৭০.৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
আবার মানসিকসমস্যা জনিত কারণে নিত্যদিনের ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। যেমন অতিরিক্ত ঘুম অথবা নিদ্রাহীনতায় ৭১.৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী ভুগছেন। যা লেখাপড়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া
ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনের কথাও জানান জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। যেমন হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়া বা অনেককিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, বর্হিমুখী (এক্সট্রোভার্ট) কিংবা আত্মকেন্দ্রীক (ইন্ট্রোভার্ট) হয়ে উঠার প্রবণতাও তাকে শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করছে জানায় ৪৭.৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
অভিভাবকদের ‘অযাচিত’ চাপ
অভিভাবকদের অতিরিক্ত স্বপ্ন বা প্রত্যাশার চাপে ৫৫.৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী হাঁসফাস করছে জানা আঁচল। অনেক শিক্ষার্থীই মনে করছেন পরিবার থেকে তৈরি হওয়া ‘অযাচিত’ চাপে তারা পিষ্ঠ।
একাডেমিক চাপে নাজেহাল
কোভিড মহামারী পরবর্তী বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার সময় অতিরিক্ত পড়াশোনারর চাপে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। এটি ৭৭.০১ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন বলে উঠে এসেছে এবারের সমীক্ষায়।
একইসাথে একাডেমিক পরীক্ষাগুলোর মধ্যবর্তী সময় কম থাকায় ৬৭.১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে দীর্ঘ বিরতির পর লেখাপড়ার ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আসায় ৭৩.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মবিশ্বাস আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে।
এছাড়া সিলেবাস দ্রুত শেষ করার চাপে ৬৬.৭১ শিক্ষার্থীর বিভিন্ন ধরনের মনের সমস্যা তৈরি হয়েছে।
ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং অনিশ্চয়তা
৭৬.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন চাকুরী ক্ষেত্রে ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং অনিশ্চয়তার কারণে মানসিক চাপে আছেন। এর মধ্যে ৭২২ জন মেয়ে ও ৫৩৫ জন ছেলে রয়েছে। এতে দেখা যায় যে, তুলনামূলক ভাবে মেয়েরা ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি চিন্তিত।
সেশনজটের শিকার ৬৩.৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী
আঁচল ফাউন্ডেশনের এবারের জরিপে দেখা গিয়েছে , দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে ৬৩.৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন মেয়াদে সেশনজটের শিকার হয়ে আটকে পড়েছেন। এদের মাঝে ৪২.৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তারা নূন্যতম এক বছর সেশনজটের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ দেশের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী নূন্যতম একবছর শিক্ষাজীবনে পিছিয়ে পড়েছেন।
আবার দুই বছর সেশনজটের শিকার হয়েছেন ১৩.১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ছয় মাস ও অন্যান্য মেয়াদে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী এর ভুক্তভোগী। সেশনজটের শিকার হওয়ায় পারিবারিক ও সামাজিক চাপ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ৬১.৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী।
ক্যারিয়ার ভাবনায়ও বিপদ সংকেত
শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক ভাবনায় সবচেয়ে এগিয়ে রাখছে সরকারি চাকুরীকে। ৩৮.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত হতে চান। আবার ৩১.১০ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে চান। বেসরকারি চাকরি করতে আগ্রহী মাত্র ৮.৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে ব্যবসা ও ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান গড়তে চান ১০.০৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর সরকারী চাকুরী পাবার ঝোঁক কিছুটা ভীতি জাগানিয়া। কারণ এদের মাঝে যারা সরকারি চাকুরী পেতে ব্যর্থ হবেন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন।
বিশেষজ্ঞ মতামত
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ এবং বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি ড. মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, ”করোনার সময়ে ও করোনা পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেক গবেষণায় ও খবরে উঠে এসেছে। এর কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে শুরু করে মানসিক শান্তির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
“সেই সাথে যুক্ত হয়েছে পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষার চাপ, সামাজিকতা, ব্যক্তিগত হতাশার মত বিষয়। এইসব নানা ব্যাপার শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পিছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে, আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে এবং এর প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন পথ খুঁজে বেরাচ্ছে, অনেকক্ষেত্রে সফলকামও হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধের নিশ্চিত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের কাজ সম্পাদন করার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দসহ এ সংক্রান্ত জাতীয় নীতি ও তার শতভাগ প্রয়োগের উদ্যোগ নিশ্চিত করা জরুরি।”
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরণের মানসিক সমস্যা এবং আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। যে সমস্যাগুলো নিয়ে তারা ভুগে থাকেন তাদের অনেকগুলোরই চাইলে সমাধান করা যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়াশুনার সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি, মন খুলে কথা বলার মত সামাজিক পরিবেশ তৈরি ইত্যাদির মাধ্যমেও তাদের এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব।”
সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবনা
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য দায়ী যে সমস্যাগুলো বিবেচনায় আঁচল ফাউন্ডেশন সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে। সেগুলো হলো-
শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাভাবিক ও ইনফরমাল সম্পর্ক তৈরি করা।
অতিরিক্ত সিলেবাস কমিয়ে যথাসময়ে পরীক্ষা সম্পন্ন করে সেশনজট মুক্ত করা।
পড়াশোনাকে আনন্দময় ও বাস্তবমুখী করা।
প্রথাগত সিলেবাসের পরিবর্তে চাকুরী বাজারের উপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন।
শিক্ষাঋণ (Education loan) চালু করা।
স্ব স্ব ক্যাম্পাসে খন্ডকালীন চাকুরীর ব্যবস্থা করা।
ক্যারিয়ার গঠনে পরামর্শ ও সহায়তা পেতে বিভাগের উদ্যোগে অ্যালামনাইদের সাথে যোগাযোগ জোরদার করা।
জরুরি ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ।
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনার আয়োজন করা।
শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া।