দেশের মানুষকে ভালো রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি: প্রধানমন্ত্রী

পাশাপাশি এই সঙ্কটকালে সবাইকে কৃচ্ছ্র সাধন এবং সঞ্চয় করার পরামর্শ দিয়েছেন সরকার প্রধান।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2022, 06:05 PM
Updated : 6 Nov 2022, 06:05 PM

মহামারীর মধ্যে যুদ্ধ বিশ্বে যে সঙ্কট তৈরি করে করেছে, তা থেকে দেশের মানুষকে রক্ষায় প্রাণপন চেষ্টা চালানোর কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই পরিস্থিতি বুঝে সবাইকে সাশ্রয়ী হতেও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

রোববার একাদশ সংসদের ২০তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে সঙ্কটের চিত্র এবং তা মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

তার বক্তব্যের আগে বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের অর্থনৈতিক সংকট বাড়ার মধ্যে সরকারের বর্তমান এবং ভবিষ্যত পদক্ষেপ কী, তা জানতে চান।

মহামীর পরিস্থিতির উন্নতির মধ্যে বছরের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ বিশ্বকে বড় গাড্ডায় ফেলে দিয়েছে। খাদ্য সঙ্কটে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে সংসদে দেওয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতি, রিজার্ভ, বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিসহ সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “যেখানে উন্নত দেশ হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের তো ভুগতেই হবে। আমি তো বলেছি, আমাদের তৈরি থাকতে হবে যে কোনো অবস্থায়।

“আমরা তো দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা, দেশের মানুষ যেন ভালো থাকে। আমরা অর্থনীতিটা ধরে রাখতে প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছি। এক কোটি মানুষকে কার্ড দিয়েছি। তাদের ৩০ টাকা কেজিতে চাল দিয়ে যাচ্ছি। তেল, চিনি, ডাল কম মূল্যে সরবরাহ করে যাচ্ছি।”

জ্বালানির বিশ্ববাজার অস্থির হওয়ায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানান।

“সুইচগুলো বন্ধ রাখলে বিলটা কম উঠবে। ইংল্যান্ডে এটি কড়াকড়িভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের বিল বাড়লে কিন্তু ফাইনও করবে তারা। তারা ৮০ শতাংশ বিদ্যুতের বিল বাড়িয়েছে। সেখানে রেশন করা হয়েছে। ইউরোপ এই শীতের সময় প্লান করছে কীভাবে তারা বিদ্যুত সরবরাহ করবে।”

সবাইকে অর্থ সাশ্রয় করার আহ্বানও জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের উপর একটা চাপ আছে। অবশ্য ঋণপত্র খোলার জন্য যে বাড়তি চাপ, তা ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি। জানুয়ারি ২৩ থেকে যাতে ডলারের চাপ কেটে যায় সেদিকে দৃষ্টি দিয়েছি।”

দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতির বিষদ বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি গিয়েছিলাম। করোনার কমে যাওয়ার পর সব কিছু উন্মুক্ত হওয়ায় আমাদের আমদানি বাড়তে থাকে। সাথে সাথে আমাদের রিজার্ভ কমতে থাকল। ৩ নভেম্বর ২০২২ তারিখে ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন আমাদের যে রিজার্ভ আছে, সেটা নিয়ে অন্তত ৫ মাসের আমদানি করা সম্ভব। আনর্জাতিক মানদণ্ডে তিন মাসের আমদানি করার মতো রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট।”

সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, “রিজার্ভ গেল কোথায়- শুধু বললে তো হবে না। আমরা বিনা পয়সায় করোনার ভ্যাকসিন দিয়েছি। এই ভ্যাকসিন কিন্তু ডলার দিয়ে কিনতে হয়েছে। সিরিঞ্জ কিনতে হয়েছে। করোনাকালে চিকিৎসাকর্মীদের আলাদা ভাতা দিয়েছি।”

সরকার সার্বিক বিষয়ে সতর্ক রয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী এদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেছেন বলেও জানান।

“ভবিষ্যতে আমাদের কী করণীয়, সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের বিলাস দ্রব্যের আমদানি কমাতে হবে। বা এর ওপর আমাদের ট্যাক্সও বসাতে হবে বেশি করে।”

দেশবাসীর উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের আঙ্গুর-আপেল না খেলে কী হয়? এখন আমাদের দেশীয় ফল তো প্রচুর আছে। আমাদের তরমুজ, আমরা কত কিছু আছে। আমাদের নিজেদের তো আছে। সবাইকে বলব, এই বিষয়ের প্রতি সকলকে দৃষ্টি দিতে হবে।

“খাদ্য উৎপাদনটা বাড়ানো, আমদানিকৃত জিনিসের উপর নির্ভরশীলটা কমানো- সেই জিনিসটা আমাদের করতে হবে। সাথে সাথে রপ্তানি বাড়ানো-কোনে দেশে কী পন্য রপ্তানি করা যায় তারজন্য আমরা চেষ্টা করছি।”

যুদ্ধের কারণে খাদ্যদ্রব্য, সার, বীজ ও তেল আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “পণ্য পাওয়াও মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি। প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বেড়েছে। এতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ বা যাদের জ্বালানি তেল, গ্যাস, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতে হয়, তাদের সকলেই সংকটে পড়েছে। তারপরও আমাদের সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”

ডেঙ্গু মোকাবেলায়ও সরকারের পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পরিবহন ধর্মঘটের প্রসঙ্গ টেনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, “বাস মালিকরা যদি বাস না চালায়, তাহলে আমরা কী করতে পারি?”

২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে। জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। এই যাদের অবস্থা তাদের কি জনগণ ভোট দেবে? খালেদা জিয়া কেন জেলে? তিনি তো ‍দুর্নীতির দায়ে জেলে। অর্থ পাচারে তারেক জিয়া সাজাপ্রাপ্ত। জানি না ,বাংলাদেশের মানুষ যদি ভোট দেয়, আমার কিছু বলার নেই।”

এর আগে সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপি নাকি ১০ ডিসেম্বর রাস্তায় বেরোবেন। ১০ ডিসেম্বর নাকি বিজয় মিছিল করবেন খালেদা জিয়াকে নিয়ে। তার মানে লাঠিসোঁটা নিয়ে নামবেন? এর বিরুদ্ধে খেলা হবে। বাড়াবাড়ি করলে ছাড় দেব না।”

‘খেলা হবে’ স্লোগান নিয়ে জাতীয় পার্টির ফিরোজ রশীদের সমালোচনার জবাবে কাদের বলেন, “এই পলিটিক্যাল হিউমার আছে। কালকে বাড্ডায় দেড়-দুই লাখ মানুষ সারা মাঠ খেলা হবে বলেছেন। জনগণ তো এটা অপছন্দ করছেন না।”

যুদ্ধ না হলেও হয়ত মন্দা আসত: জি এম কাদের

অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধির মধ্যে সরকারের বর্তমান কী পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ নেবে তা জনগণকে জানানো দরকার বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

২০তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের একটি কারণ। কিন্তু যুদ্ধ না হলেও হয়ত দেশে এই অর্থনৈতিক মন্দা আসতো।”

তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “দেশের রিজার্ভ কমা শুরু হয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ারও ছয়-সাত মাস আগ থেকে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রিজার্ভ কমার পরিমাণ বেড়েছে। বড় সংকট হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব পদ্ধতির হিসাবে বলছে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৮৫ ডলার। কিন্তু আইএমএফ বলছে, রিজার্ভের পরিমাণ ২৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।”

আইএমএফের ঋণ পেলেও রিজার্ভ পরিস্থিতি ‘সুখকর’ হবে না বলেও মনে করেন তিনি।

“আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। সেটা পাওয়া গেলেও রিজার্ভের অবস্থা সুখকর হবে না। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এখন বড় ধরনের সংকট।”

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য টেনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, “এই পরিস্থিতির জন্য কিছু উচ্চাভিলাসী প্রকল্প দায়ী। এগুলোর যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। বাস্তবায়নে বারবার সময় ও ব্যয় বাড়ছে।

“মানুষ মনে করছে, রিজার্ভ সংকট চলছে, সংকট বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিদিন কমছে। টাকার মূল্যমান কমে যাচ্ছে। একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে দেশ যাচ্ছে।”

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেন, “ডেঙ্গুর সংক্রমণ এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট আলাদা করার যন্ত্র ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে নেই।”

নিজের হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন উদ্ধার করে দেওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান তিনি।