দগ্ধদের স্বজনরা জানাচ্ছেন, দুর্মূল্যের বাজারে রোজগার বন্ধ। চিকিৎসার খরচ তারা কুলাতে পারছেন না। সরকার বা কাউকে তারা পাশে পাচ্ছেন না।
Published : 14 Nov 2023, 12:20 AM
শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শয্যায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাতরাচ্ছেন বাসচালক সবুজ মিয়া। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বলতে তিনিই। কিন্তু রোজগার বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে স্বজন আর পরিচিতজনদের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। কবে সুস্থ হয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিতে পারবেন; আয়ে ফিরবেন সেই দুশ্চিন্তায় দিন পার করতে হচ্ছে তার পরিবারকে।
শুধু সবুজই নন; বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধের মধ্যে যানবাহনে দেওয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও পাঁচজন। তারা সবাই নিম্নআয়ের মানুষ। সবুজের মতই তাদের দুশ্চিন্তা।
দগ্ধদের স্বজনরা জানাচ্ছেন, একে তো দুর্মূল্যের বাজারে রোজগার বন্ধ, তার ওপর চিকিৎসার খরচ তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সরকার বা কোনো সংস্থাও তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না।
ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক তরিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখানে এ পর্যন্ত ৬ জন দগ্ধ হয়ে এসেছে। পেট্রোলে দগ্ধের কারণে তাদের শরীরে ক্ষতগুলো গভীর। তারা শঙ্কামুক্ত হলেও অনেকেরই অপারেশন প্রয়োজন হচ্ছে।”
এ ইনস্টিটিউটে দগ্ধ যারা ভর্তি আছেন তারা হলেন- রিকশাচালক আব্দুল জব্বার, পোশাক শ্রমিক মাহমুদুল হাসান, পরিবহন শ্রমিক সবুজ মিয়া, মেকানিক বিপ্রজীত ভাওয়ালী, পরিবহনকর্মী শাখাওয়াত হোসেন ও বাসের হেলপার রবিউল ইসলাম রবি।
চিকিৎসক তরিকুল জানান, জব্বারের শরীরের ২০ শতাংশ, মাহমুদুলের ১১ শতাংশ, সবুজের ২৮ শতাংশ, বিপ্রজীতের ৭ শতাংশ, শাখাওয়াতের ১০ শতাংশ ও রবির ১৭ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘর্ষের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এরপর থেকে হরতাল এবং দফায় দফায় ডাকা অবরোধে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়া শুরু হয়।
ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে ২৮ অক্টোবর থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৩৮টির মতো যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে।
বাসে আগুনের ঘটনায় একজন পরিবহনকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। গত ২৯ অক্টোবর ভোরে ডেমরার দেইল্লা বাস স্টেশনে রাস্তার পাশে রাখা অছিম পরিবহনের একটি বাসে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যান ওই বাসের হেলপার নাঈম। ওই ঘটনায় দগ্ধ হন নাঈমের বন্ধু আরেকটি বাসের হেলপার রবিউল ইসলাম রবি।
যাত্রাবাড়ীতে গত ১১ নভেম্বর রাতে অনাবিল পরিবহনের বাসে দেওয়া আগুনে দগ্ধ হন আব্দুল জব্বার ও পোশাক শ্রমিক মাহমুদ হাসান। ওই রাতেই তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়।
জব্বারের বড় ভাই জিকরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার ভাই রামপুরার একটি গ্যারেজের রিকশা চালাতেন। তাদের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বামন-বামনী গ্রামে। জব্বারের স্ত্রী ও চার সন্তান রয়েছে।
জিকরুল বলেন, রিকশা চালিয়ে স্ত্রীসহ চার সন্তানের ভরণ-পোষণ করতে পারছিলেন না জব্বার। অভাব লেগেই থাকত। সে কারণে গত ১১ নভেম্বর ভাইয়ের স্ত্রী ও সন্তানদের নিজের কাছে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যান জিকরুল। ইচ্ছে ছিল জব্বারের স্ত্রী ও দুই ছেলেকে কোনো কাজে লাগিয়ে দেওয়া।
জব্বার তার কাজ শেষ করে রাতে নারায়ণগঞ্জে ভাইয়ের বাসায় যেতে অনাবিল পরিবহনের বাসে উঠেছিলেন; যাত্রাবাড়ীতে দুর্বৃত্তরা সেই বাসে আগুন দিলে দগ্ধ হন।
“হামরা গরীব মানুষ বাহে। এইনেই (এমনিতেই) সংসার চলে না। এর মইধ্যে ভাইডা মোর পোড়া গেইল। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থাকি ধার নিয়া ভাইয়ের চিকিৎসা করছি।”
ভাইয়ের চিকিৎসা জন্য সরকারের সহায়তাও চাইলেন তিনি।
একই বাসে দগ্ধ হওয়া যাত্রী মাহমুদুল হাসান নারায়ণগঞ্জের পুলিশ লাইন এলাকার বাসিন্দা, কাজ করেন মনিরা অ্যাপারেলসে মেশিন অপারেটর হিসেবে। তার বাড়ি কুমিল্লার হোমনায়।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, এক বন্ধুর মোবাইল ফোন কিনতে বসুন্ধরা শপিংমলে গিয়েছিলাম। সেদিন অবরোধও ছিল না। নারায়ণগঞ্জে ফেরার পথে বাসে উঠে বসেছিলাম মাঝামাঝি।
“যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাসটি আসার পর হঠাৎ দেখি আমার পায়ের নিচ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। দ্রুত কোনোরকমে জানালা দিয়ে বাস থেকে বের হই, কিন্তু ততক্ষণে আমার দুই পা ও ডান হাত ঝলসে গেছে।”
এর আগে ৫ নভেম্বর সকাল সোয়া ৭টার দিকে মেরাদিয়া বাঁশপট্টি এলাকায় অছিম পরিবহনের বাসে দেওয়া আগুনে ঝলসে যান সবুজ মিয়া, যিনি রমজান পরিবহন নামের আরেকটি বাসের চালক।
সবুজের স্ত্রী রুশেদা বেগম জানান, সবুজ যে বাসে ছিলেন সেটি ছিল মেরাদিয়া রাস্তার পাশে।
“ডিউটিতে যাওয়া জন্য ওইদিন সকালে মেরুল বাড্ডায় আনন্দনগরের বাসা থেকে বের হয়ে বাসে করে মেরাদিয়া বাঁশপট্টি গিয়ে নামার আগে অছিম পরিবহনের বাসটিতে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। চালক আগুন দেখে বাস রাস্তার পাশে গর্তে নামিয়ে দেন, সেই আগুনে সবুজ দগ্ধ হন।”
২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন বিকালে রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে পুলিশের রিকুইজিশন করা এশিয়া পরিবহনের বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। সেই আগুনে দগ্ধ হন বাসের সুপারভাইজার শাখাওয়াত হোসেন। তিনি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার কংঙ্গাইল গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে।
শাখাওয়াতের ভাই লেপ-তোশকের দোকানের কর্মী আলকাছ মিয়া ভাইয়ের চিকিৎসার দেখভাল করছেন।
তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে চিকিৎসা ফ্রি। তারা যে ওষুধ বাইরে থেকে আনছেন সেগুলোর রশিদ জমা দিলে টাকা দেওয়া হবে বলে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে। তবে গত ২৮ অক্টোবর থেকে সবার থাকা-খাওয়া আর ওষুধ খরচ মিলিয়ে গড়ে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে।
আলকাছ হাসপাতালে ছিলেন কয়েকদিন। সবার রোজগার বন্ধ থাকলে তো বিপদ। এই ভেবে এখন শাখাওয়াতের স্ত্রী তামান্না ১৩ মাসের সন্তান নিয়ে হাসপাতালে থাকছেন।
অন্যদিকে গত ৮ নভেম্বর ভোরে গাজীপুরের কালীগঞ্জে একটি কভার্ড ভ্যানে আগুন দিলে দগ্ধ হন বিপ্রজীত ভাওয়ালী ও আনোয়ার। তাদের প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আনোয়ার বাসায় চলে যান। বিপ্রজীতকে পরে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তার মা স্বপ্না ভাওয়ালী ছেলের পাশে বসে আছেন। বিপ্রজীত জানান, তিনি ফ্রেশ কোম্পানির মেকানিক। বগুড়ায় তাদের কোম্পানির গাড়িতে সমস্যা হওয়ায় সেখানে গিয়েছিলেন। কাজ শেষে কোম্পানির একটি কভার্ড ভ্যানে করে ফিরছিলেন। পথে কালীগঞ্জ এলাকায় রাস্তায় ৯/১০ জন গাড়ি পথরোধ করে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। গাড়ি থেকে নামতে নামতেই শরীরে আগুন ধরে যায়।
তরুণ এ মেকানিক জানান, কোম্পানি থেকে তার চিকিৎসায় সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তারা খোঁজখবর রাখছে।
বিপ্রজীত রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার রতনদিয়া গ্রামের মনোরঞ্জন ভাওয়ালীর ছেলে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ মেঘনা বাস কাউন্টারের পাশে থাকেন। তারা দুই ভাই, দুজনই ফ্রেশ কোম্পানিতে কাজ করেন।