সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রতি শরতে মর্ত্যে বাবার বাড়ি আসেন দশভূজা দেবী দুর্গা; তাই আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন দুর্গোৎসব।
Published : 08 Oct 2024, 09:41 PM
ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় দেবীর অধিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হচ্ছে বুধবার। এরইমধ্যে ঢাকের বাদ্য আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে বিভিন্ন মণ্ডপ।
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রতি শরতে ‘কন্যারূপে’ মর্ত্যলোকে বাবার বাড়ি আসেন দশভূজা দেবী দুর্গা; বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়। তার এই ‘আগমন ও প্রস্থানের’ মাঝে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন চলে দুর্গোৎসব।
মহালয়ার মধ্য দিয়ে গত ২ অক্টোবর শুরু হয়েছে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হয়েছে বোধন, অর্থাৎ দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা।
বুধবার মহাষষ্ঠী, বৃহস্পতিবার মহাসপ্তমী, শুক্রবার মহাঅষ্টমী আর শনিবার হবে মহানবমীর পূজা।
পঞ্জিকা মতে এবার নবমী পূজার পরই দশমীর বিহিত পূজা হবে। তবে বিজয়া দশমী উদযাপন হবে রোববার। ওইদিন বিকালে প্রতিমা বিসর্জনের আগে হবে বিজয়ার শোভাযাত্রা।
পূজা উদযাপন পরিষদ জানিয়েছে, গতবারের তুলনায় ঢাকা মহানগরে এবার মণ্ডপের সংখ্যা বাড়লেও, সারা দেশে এই সংখ্যা কমেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে পরিষদ জানায়, দেশের ৩১ হাজার ৪৬১টি মন্দির ও মণ্ডপে এবার পূজা হবে। গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ৪০৮টি।
তবে ঢাকা মহানগরে এবার ২৫২টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, গত বছর হয়েছিল ২৪৮টিতে। সে হিসেবে মহানগরে পূজামণ্ডপ চারটি বেড়েছে।
পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা বলেন, “প্রস্তুতি নিতে অপারগ হওয়ায় ও বন্যার কারণেও দুর্গত এলাকায় কোথাও কোথাও পূজার্থীরা এবার পূজার আয়োজন করতে পারেননি।"
দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের প্রতিটি পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ, আনসার, বিজিবি, র্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি মণ্ডপে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। ঢাকেশ্বরী মন্দির মেলাঙ্গনে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হবে।
রাজধানীতে কেন্দ্রীয় পূজা উৎসব হিসেবে পরিচিত ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মণ্ডপে পূজার পাশাপাশি ভক্তিমূলক সংগীতানুষ্ঠান, বস্ত্র বিতরণ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আরতি প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় রক্তদান ও বিজয়া শোভাযাত্রা হবে।
‘দোলায় আগমন, ঘোটকে গমন’
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত রাজিব চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বছর দেবী দুর্গার আগমন হবে দোলায় বা পালকিতে। পালকি বা দোলায় দেবীর আগমন বা গমন হলে এর ফলাফল হয় ‘মড়ক’, যা শুভ ইঙ্গিত নয়। খাদ্যশস্যে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হবে। রোগব্যাধি বাড়বে।
“এছাড়া দেবী স্বর্গে গমন করবেন ঘোটকে বা ঘোড়ায়। শাস্ত্র মতে দেবীর গমন বা আগমন ঘোটকে হলে ফলাফল হয় ‘ছত্রভঙ্গ’। এটা সামাজিক ও রাজনৈতিক এলোমেলো অবস্থাকে ইঙ্গিত করে। একটা বিশৃংখল অবস্থা তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।”
দেবীর ভক্তরা বিশ্বশান্তির প্রত্যাশায় আরাধনায় রত হবেন জানিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত রাজিব চক্রবর্তী বলেন, “ভক্তের আরাধনায় দেবীর মন তুষ্ট হলে দেবী হয়ত সবার জীবনে শান্তির সুবাস ছড়িয়ে দিতে পারেন। আমরা প্রার্থনা করব, বিশ্বজুড়ে যেন শান্তি বজায় থাকে।”
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শুভেচ্ছা
হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, “সারাদেশে যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজা উদ্যাপন আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি অনন্য উদাহরণ। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার সাথে মিশে আছে চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় আবহমানকাল ধরে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে নানান আয়োজনের মাধ্যমে দুর্গাপূজা উদ্যাপন করে আসছে।
“দুর্গাপূজা ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি সামাজিক উৎসবও। দুর্গোৎসব উপলক্ষে সমাজের সকল স্তরের মানুষ একত্র হন, মিলিত হন আনন্দ-উৎসবে। সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ এ উৎসবকে সার্বজনীন রূপ দিয়েছে। ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি দুর্গাপূজা দেশের জনগণের মাঝে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ঐক্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। শারদীয় দুর্গোৎসব সত্য-সুন্দরের আলোকে ভাস্বর হয়ে উঠুক; ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বন্ধন আরো সুসংহত হোক- এ কামনা করি।”
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “দুর্গাপূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবই নয়, এটি এখন সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
“বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আমাদের সংবিধানে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। এই দেশ আমাদের সকলের। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশ সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের ভাগ্য উন্নয়ন এবং সমান অধিকার সুনিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।”
বৈষম্যবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
উৎসবের ৫ দিন
রামকৃষ্ণ মিশনে বুধবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে হবে দুর্গাদেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। উৎসবের প্রথম দিন ষষ্ঠী পূজা বিকেল ৫টার পরে আরম্ভ হবে।
অন্যদিকে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে সকাল ৮টা ১ মিনিটে ষষ্ঠীপূজা ও বিহিতপূজা এবং সন্ধ্যায় আমন্ত্রণ ও অধিবাস হবে।
বৃহস্পতিবার মহাসপ্তমী। সকালে নবপত্রিকা স্থাপন করা হবে। ‘নবপত্রিকা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান ও ধান এই নয়টি উদ্ভিদকে পাতাসহ একটি কলাগাছের সঙ্গে একত্র করা হয়।
পরে একজোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম ‘কলাবউ’।
নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে বিবেচনা করা হয়। এই নয় দেবী একত্রে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা’ নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমোঃ’ মন্ত্রে পূজিত হন।
নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। দুর্গাপ্রতিমার সামনে একটি দর্পণ বা আয়না রেখে সেই দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন উপচারে দেবীকে স্নান করানো হয়।
শুক্রবার মহাঅষ্টমী। আর অষ্টমী পূজার মূল আকর্ষণ কুমারী পূজা। এদিন ফুল, জল, বেলপাতা, ধূপ-দীপসহ ষোড়শ উপচারে কুমারীরূপে দেবী দুর্গারই আরাধনা করা হয়। ঢাকায় সবচেয়ে বড় পরিসরে কুমারী পূজা হয় রামকৃষ্ণ মিশনে ।
শনিবার মহানবমী। এদিন সকালে তর্পণে দুর্গার মহাস্নান হবে, ষোড়শ উপচারে পূজা করা হবে। পুষ্প, অর্ঘ্য নিবেদন শেষে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন ভক্তরা। কোনো কোনো মণ্ডপে নবমীতে যজ্ঞের আয়োজন হয়। মহানবমীতে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে শুরু করে ভক্তদের হৃদয়।
পঞ্জিকা মতে এবার মহানবমী পূজার পরই দশমী বিহিত পূজা হবে।
রাজধানীতে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতৃত্বে রোববার বিকালে পলাশী মোড় থেকে হবে দশমীর বিজয়া শোভাযাত্রা।
বিজয়া দশমীতে একদিকে ‘আনন্দময়ী মাকে’ বিদায় জানানোর পালা, আবার আসন্ন বছর ‘মা’ আবার আসবেন সেই অপেক্ষার শুরু। সেদিন প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে শেষ হবে এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব।