‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ প্রতিবাদ্য নিয়ে এবারের মেলা হতে যাচ্ছে।
Published : 29 Jan 2025, 11:55 PM
চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। চারদিকে হাতুড়ি-পেরেকের ঠুকঠুক শব্দ। কোথাও রং লাগাচ্ছেন মিস্ত্রিরা। মাঠেই অস্থায়ী হার্ডওয়্যারের দোকান খুলে বসেছেন কেউ কেউ। অমর একুশে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ প্রবেশ করতেই দেখা গেল এমন চিত্র।
উদ্যানের খোলা মাঠে আল মদিনা হার্ডওয়্যার স্টোর নামে একটি অস্থায়ী দোকানের সামনে দেখা গেল ভিড়। সেখানে বিক্রি হচ্ছে বালতি, বেলচা, নাট-বল্টু, দড়ি, রং, চুন, বার্নিশ ও পেড়েকের মত পণ্য।
এই দোকানে রং কিনতে এসেছেন একটি স্টলের রংমিস্ত্রি শামীম। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “মাঠে তো শত শত স্টলের কাজ হচ্ছে। সব স্টলেই তো নির্মাণ কাজের এই সামগ্রীগুলো কিনতে হয়। এজন্য কেউ কেউ এখানে এরকম ভ্রাম্যমান দোকান বসান। আমরা তাদের কাছ থেকে রংসহ অন্যান্য পণ্য কিনি।”
শামীম জানান, এবারের মেলায় চারটি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের স্টল নির্মাণের কাজ পেয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে নয়জনের একটি দল কাজ করছে।
গতবারের মেলায় চার ইউনিটের স্টল থাকলেও এবারই প্রথম প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পেয়েছে প্রকাশনা ও বই বিপণন কেন্দ্র বাতিঘর। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার তো মেলা আরও বড় পরিসরে হচ্ছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, আয়তনও বেড়েছে। সার্বিক প্রস্তুতি ভালোয় মনে হচ্ছে। ৮০ শতাংশ স্টল নির্মাণ শেষ বলা যায়।”
বাতিঘর থেকে এবার ৬০টির মত নতুন বই প্রকাশ হবে বলে জানান দীপঙ্কর দাশ। তিনি বলেন, “২৫টির মত বই আমাদের ছাপাও হয়ে গেছে। বাকিগুলোও চলে আসবে দ্রুত। মেলা এবার ভালো হবে বলে মনে করছি।”
এর আগে লিটলম্যাগ চত্বরে স্টল বরাদ্দ পেলেও এবারই প্রথম শিশুদের চত্বরে স্টল পেয়েছে শিশুদের পত্রিকা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘দোলন’।
দোলন-এর স্বত্বাধিকারী কামাল মুস্তাফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের স্টলের কাজ অনেকটাই শেষ। রাতেও আমরা কাজ করেছি। সেজন্য আমরা এখন প্রস্তুত। প্রথম দিন থেকেই আমরা বই নিয়ে অপেক্ষায় থাকব বইপ্রেমী শিশুদের।”
এবার ১৫টির মত নতুন বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা আছে জানিয়ে কামাল বলেন, “আশা করি ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমাদের সব নতুন বই মেলার মাঠে চলে আসবে।”
‘জনআকাঙ্ক্ষার মেলা’
‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ প্রতিবাদ্য নিয়ে এবারের মেলা হতে যাচ্ছে। রীতি অনুযায়ী সরকার প্রধান আগামী ১ ফেব্রুয়ারি মেলার উদ্বোধন করবেন। ইতোমধ্যে স্টল বরাদ্দ দেয়া এবং অনুষ্ঠান সূচি সাজানোর কাজও শেষ করে এনেছে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি।
মেলার সার্বিক প্রস্তুতি ও যাবতীয় বিষয় নিয়ে ৩০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন হবে বলে আয়োজন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
মেলার সদস্য-সচিব সরকার আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার আমরা সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করছি একটা নান্দনিক বইমেলা আয়োজন করতে। লেখক, প্রকাশকসহ বইমেলা সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতাও পাচ্ছি। সাম্প্রতিক জুলাই গণঅভ্যুথানে যে জনআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, মেলায় তার প্রতিফলন থাকবে। জনবান্ধব বইমেলা সবাই মিলে আয়োজনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
মেলায় এবার কোনো নিরাপত্তা শঙ্কা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা এমন কিছু মনে করছি না। বইমেলা সকলের মেলা। এই মেলার পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এমন কিছু হবে না বলে আমাদের বিশ্বাস আছে। সবাই মিলে আমরা বইমেলাকে সফল করব।”
জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাতি গঠনের লক্ষ্যে প্রতিবছর ‘অমর একুশে বইমেলা’ আয়োজন করছে বাংলা একাডেমি। এই মেলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, “ভাষা-চেতনা ও একুশের চেতনা জাগরুক রাখা, গ্রন্থপাঠে উদ্বুদ্ধকরণ, বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য এবং চিন্তা-চেতনার মানসম্পন্ন চর্চার প্রচার ও প্রসার এবং দেশীয় প্রকাশনা শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান।”
মেলার নীতিমালায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান বিরোধী, ‘যে কোনো জাতিসত্তা বিরোধী, অশ্লীল, রুচিগর্হিত, শিষ্টাচারবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন বা জননিরাপত্তার জন্য বা অন্য কোনো কারণে বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর কোনো বই বা পত্রিকা বা দ্রব্য’ অমর একুশে বইমেলায় বিক্রয়, প্রচার ও প্রদর্শন করা যাবে না।
প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহর অর্থাৎ সকাল ৭টা হতে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে। বইমেলা সবার জন্য উন্মুক্ত।
এবারও মেলায় মূল মঞ্চে থাকবে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। পাশাপাশি লেখক বলছি মঞ্চেও থাকবে আয়োজন। থাকবে বইমেলায় নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য ‘মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ’।
অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে 'চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার' এবং ২০২৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে 'মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার' দেওয়া হবে।
এছাড়া ২০২৪ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে 'রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার' এবং এ-বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে 'কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার' দেওয়া হবে।
ইতিহাসের পাতায়
১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেইটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারা’র প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা।
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানমালার সাথে সঙ্গতি রেখে একাডেমির ভেতরে ছোট একটি স্টল স্থাপন করে বই বেচে মুক্তধারা। ১৯৭৭ সালে মুক্তধারার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেয়, সেই থেকে একুশে বইমেলার সূচনা।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এর পরের বছরই বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়।
মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ১৯৮৩ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমির এই বইমেলা এখন বাঙালির মননের মেলায় পরিণত হয়েছে।
১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে মেলা পরিচালনা করছে।
২০২০ সালের মেলার উদ্বোধনপর্বে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে ‘গ্রন্থমেলা’র পরিবর্তে ‘বইমেলা’ শব্দটি ব্যবহার অধিক শ্রুতিমধুর ও পাঠকপ্রিয় হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এর পরের বছর বইমেলার প্রাতিষ্ঠানিক নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’।