“প্রধানমন্ত্রী এই লেকে ঘুরতে এলে আমার ধারণা তিনিও এখন ক্ষুব্ধ হবেন," বলছেন স্থপতি ইকবাল হাবিব।
Published : 13 Jun 2024, 01:31 AM
বছর পাঁচেক আগেও ঢাকার ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে গেলেই চোখে পড়ত গিটার হাতে তরুণদের গানের আড্ডা। রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে দেখা যেত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠান।
এখন আর তেমন দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। সংস্কৃতির নানা আয়োজনে মুখর থাকা এই প্রাঙ্গণজুড়ে গড়ে উঠেছে খাবারের দোকানপাট। আর তাতে পুরো প্রাঙ্গণই হাটবাজারের রূপ পেয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চের ভাড়া বেশি হওয়ায় এই মঞ্চে অনুষ্ঠান আয়োজনে আগ্রহ হারিয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। ফলে যে উদ্দেশ্যে মঞ্চটি বানানো হয়েছিল, তা ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।
১৯৯৬ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ধানমন্ডি লেকের উন্নয়নকাজ শুরু করে, যার নকশা করেছিলেন স্থপতি ইকবাল হাবিবের নেতৃত্বে একটি দল।
ইকবাল হাবিব বলেন, ধানমন্ডি এলাকার পাশাপাশি নগরের অন্য এলাকার মানুষের চিত্ত-বিনোদনের বিষয়টি মাথায় রেখেই রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চটি করা হয়।
কিন্তু এখন নকশার প্রতিফলন পার্কটিতে নেই মন্তব্য করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ধানমন্ডি লেকে এখন আমার আর যেতেও ইচ্ছা করে না, এটা দেখতেও ইচ্ছা করে না। নিজের সৃষ্টি এভাবে নষ্ট হলে কার ভালো লাগে? অনেকটা রাগ-ক্ষোভ থেকেই আমি আর সেদিকে যাই না।"
ধানমন্ডি লেক এখন পুরোপুরি ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে গেছে মন্তব্য করে ইকবাল হাবিব বলেন, "রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ কি বাণিজ্য করার জন্য বানানো হয়েছিল? এখন সেখানে খাবারের দোকান বসিয়ে একটা বাণিজ্যিক হাট বানানো হয়েছে।
“ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতাকে ইজারা দিয়ে ধানমন্ডি লেককে নষ্ট করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার কাজ করিয়েছিলেন, ধানমন্ডি লেক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আবেগের কথা আমরা অনেকেই জানি।”
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “এখানে রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চটি করা হয়েছিল যেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখর থাকে। কিন্তু এখন কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না। পুরো চত্বরটিই বিকালের পর থেকে বাজারে রূপান্তরিত হয়।
“কেবল খাবারের দোকান ছাড়া কিছু দেখা যায় না। প্রধানমন্ত্রী এই লেকে ঘুরতে এলে আমার ধারণা তিনিও এখন ক্ষুব্ধ হবেন।"
রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চের পাশে খাবারের দোকান কি নকশায় ছিল? উত্তরে ইকবাল হাবিব বলেন, “যতদূর মনে পড়ে এখানে চারটি ‘ভ্রাম্যমাণ ফুডভ্যান’ রাখার ব্যাপার ছিল। কিন্তু স্থায়ী অবকাঠামো বানানোর কথা ছিল না।”
কিন্তু রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চের দর্শক গ্যালারির ঠিক পেছনে অনেকটা স্থায়ী কাঠামো বানিয়ে রেস্তোরাঁ পরিচালনা করা হচ্ছে। সেখানে রয়েছে জুসবার অ্যান্ড কাবাব, কাবাব বাড়ি, কাবাব কারিগর অ্যান্ড স্যুপ এবং ব্যাচেলর পয়েন্ট ভ্যারাইটিজ কাবাব নামে চারটি রেস্তোরাঁ।
তার পাশেই অনেকটা জায়গাজুড়ে সাজিয়ে রাখা আছে বসার চেয়ার। বিকালের পর থেকে ভোজনরসিকদের ভিড়ে জায়গাটি সরগরম থাকে। গ্যালারিতে বসেও অনেককে খেতে দেখা যায়। কিন্তু রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চটি ফাঁকা পড়ে থাকে।
ইজারাদার প্রতিষ্ঠান নিয়ম মানছেন কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব।
মঞ্চের ভাড়া ঠিক হয় কীভাবে?
কেন রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে অনুষ্ঠান করতে আগ্রহ হারিয়েছে সংস্কৃতিকর্মীরা, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল- লাখ টাকা ভাড়া গুনতে হয় মঞ্চটি ব্যবহারের জন্য। এর ফলে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এই মঞ্চে অনুষ্ঠান করতে আগ্রহী নয়।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এই মঞ্চে তিন দিনের বিজয় উৎসব আয়োজন করেছিল। যার জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়েছিল তাদের।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিজয় উৎসব করার জন্য মঞ্চটি বরাদ্দ পেতে যোগাযোগ করলে তিন দিনের জন্য ৩ লাখ টাকা ভাড়া চাওয়া হয় বলে জোটের একাধিক নেতা জানিয়েছেন। ভাড়ার সঙ্গে ইলেকট্রিসিটি বিল এবং অন্যান্য খরচ আলাদা দেওয়ার শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রবীন্দ্র সরোবার মঞ্চটি আমরা কোভিডের আগে ব্যবহার করেছি ৮ হাজার টাকা ভাড়ায়। কিন্তু ২০২২ সালে আমাদেরকে বলা হয়, প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। ওই বছর আমরা তিন দিনের অনুষ্ঠানের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধও করেছি।
“আর গেল বছর আমরা যখন মঞ্চটি নিতে চেয়েছি, তারা আমাদের কাছে প্রতিদিন ১ লাখ টাকা করে ভাড়া চেয়েছে। পরে সেখানে আর অনুষ্ঠান করিনি আমরা।"
ধানমন্ডি লেককে সাতটি সেক্টরে ভাগ করে ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চটিসহ আশপাশের খাবারের দোকানগুলো পরিচালনা করেন গোলাম রাব্বানী হিরু। তার প্রতিষ্ঠান 'ফোর আর ট্রেডিং' এটি ইজারা নিয়েছে।
ইজারা পেতে সিটি করপোরেশনকে কোটি টাকা দিতে হয়েছে দাবি করে হিরু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "১ কোটি ২১ লাখ টাকা দিয়ে আমি ইজারা নিয়েছি। নিয়ম মেনেই এখানে খাবারের দোকান পরিচালনা করা হচ্ছে এবং মঞ্চটিকে ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে।”
মঞ্চ ভাড়া কীভাবে নির্ধারণ হয়, এ প্রশ্নের উত্তরে হিরু বলেন, “অনুষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া হয়। কেউ যদি স্পন্সর নিয়ে বাণিজ্যিক অনুষ্ঠান করে, তবে তো আমরা বেশি টাকা ভাড়া নেব। আবার কিছু সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য বিনামূল্যেও মঞ্চ ব্যবহার করতে দিয়েছি। এখন তো অনুষ্ঠানই তেমন হয় না।
“আমরা তো টাকা দিয়েই এটি ইজারা নিয়েছি। আমাদেরও তো পোষাতে হবে। এজন্য অনুষ্ঠান অনুযায়ী আমরা ভাড়া ঠিক করি। যেমন বাণিজ্যিক কনসার্টের জন্য ৩ লাখ টাকাও নিয়েছি।"
মঞ্চ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়মিত খরচ আছে জানিয়ে হিরু বলেন, “সারা বছর তো অনুষ্ঠান থাকে না। কিন্তু জায়গাটি পরিষ্কার রাখাসহ নানা রকম খরচ আছে আমাদের।”
রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বেশি ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, “রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ তো অনুষ্ঠান করার জন্যই বানানো হয়েছে। সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন যদি বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেন, তারা মেয়র মহোদয় বরাবর লিখিতভাবে জানাতে পারেন।”
রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চের ভাড়ার হার সিটি করপোরেশন থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন থেকে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া নেই। মূলত ইজারাদার প্রতিষ্ঠানই ভাড়া ঠিক করে।
“সিটি করপোরেশন পুরো ধানমন্ডি লেককে ৭টি সেক্টরে ভাগ করে ইজারা দিয়েছে। এর মধ্যে ৭ নম্বর সেক্টরের আওতায় রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চটি রয়েছে। মঞ্চটিসহ ৭ নম্বর সেক্টর যারা ইজারা নিয়েছেন, তারা মঞ্চটি দেখভাল এবং ভাড়া নির্ধারণ করবে।"
‘অযৌক্তিক’ ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ থাকলে, সেটি সিটি করপোরেশনকে জানানোর পরামর্শ দিয়ে ফারাবী বলেন, "আমাদের জানানো হলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।"
‘অযৌক্তিক’ ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি সিটি করপোরেশনকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “আমরা লিখিতভাবে জানাইনি। তবে এ বিষয়ে আমরা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলব।”