তবে হাই কোর্ট তিন দিনের মধ্যে ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের যে আদেশ দিয়েছে, বাস্তবতা বিবেচনায় তা পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
Published : 25 Nov 2024, 02:39 PM
রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর প্রধান সড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং এর যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
তবে হাই কোর্ট তিন দিনের মধ্যে ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের যে আদেশ দিয়েছে, বাস্তবতা বিবেচনায় তা পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এসব দাবি তুলে ধরেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, “দেশের সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধন ও চালকের হাতে নামমাত্র ফিতে লাইসেন্স প্রদান করা গেলে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে।
“একইসাথে ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা জাতীয় মহাসড়কে চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করা, রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর প্রধান সড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করা এবং জরুরিভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করতে হবে।”
তিনি বলেন, “অবাধে আমদানি, স্থানীয় গ্যারেজে সহজলভ্যভাবে তৈরি করে সহজে রাস্তায় নামানোর অবাধ সুযোগ থাকায় এবং দেশে অন্যান্য খাতে সহজে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায়, স্বল্পপুঁজিতে লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ ব্যাটারির রিকশা কিনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে।
“এতে কৃষিখাতে শ্রমিক সংকটসহ কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। প্রশিক্ষণবিহীন লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের হাতে এসব অটোর স্টিয়ারিং এর কারণে সড়ক নিরাপত্তায় ভয়ানক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।”
দেশের হাসপাতালগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তির চিত্র তুলে ধরে মোজাম্মেল বলেন, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, থ্রি- হুইলার, ইজিবাইক ‘নিয়ন্ত্রণহীনভাবে’ বাড়ার কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ‘ভয়াবহভাবে’ বাড়ছে।
গত ২০২৩ সালে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানসহ (পঙ্গু হাসপাতাল) বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতালে ৫৩ হাজার ২০৭ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তি হয়েছেন। দেশের ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৭ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
মোজাম্মেল বলেন, “সারাদেশের এমন ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র মোটরসাইকেলের বাণিজ্যিক ব্যবহার, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বেপরোয়া হারে বৃদ্ধির কারণে।”
তিনি বলেন, “গত ১৯ নভেম্বর হাই কোর্ট তিন দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ বা বিধি নিষেধ আরোপ করার নির্দেশ দেয়। এরই প্রেক্ষিতে সরকার রাজধানী থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উচ্ছেদ করতে গেলে পুরো রাজধানীর লক্ষ লক্ষ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক ও মালিকেরা সংগঠিত হয়ে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক পথ, রেলপথে যান চলাচল বন্ধ করে দেন।
“এতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। দেশের এক চরম অস্থির সময়ে নির্বাহী বিভাগের কাজে বিচার বিভাগ এগিয়ে আসা। মাত্র ৩ দিনের মধ্যে রাজধানী থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উচ্ছেদ বা নিয়ন্ত্রণের আদেশ দিয়েছেন, আমরা এই আদেশ পুনর্বিবেচনায় মহামান্য হাই কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ৮ টি সুপারিশ করেছে।
১. জরুরিভিত্তিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রণীত "থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১" এর খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে।
২. বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশার বডি মডিফাই করে ব্রেক ও গতির সমতা এনে সড়ক নিরাপত্তায় ঝুঁকিমুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করে নিবন্ধন নিতে হবে।
৩. সড়কের সক্ষমতা বিবেচনা করে সিলিং নির্ধারণ করে দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে, বিআরটিএর নিয়ন্ত্রণে তাদের আওতাধীন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন দিতে হবে।
৪. প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশার চালককে নূন্যতম ১ সপ্তাহের সড়ক আইন-কানুন, ট্রাফিক চিহ্ন, সড়কে মোটর রিকশা চলাচল পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রশিক্ষণ সমাপ্তকারীদের নামমাত্র ফি নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে। হুট করে গ্রাম থেকে এসে প্রশিক্ষণহীন কোনো ব্যক্তি যাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় ট্রাফিক বিভাগের সাথে সংযোগ স্থাপন করে জিপিএস লাগানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। জিপিএস ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে গতি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানীর প্রধান সড়ক, দেশের হাইওয়ে বা উপজেলা ও পৌরসভার প্রধান সড়কের যেটুকু অংশ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে সেই সড়কে প্রবেশ করামাত্র জিপিএস এর মাধ্যমে ট্রাফিক বিভাগ অটো জরিমানা আদায় করতে পারবে এমনভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।
৬. ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা জাতীয় মহাসড়কে চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর প্রধানসড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭. জরুরিভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করতে হবে।
৮. ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে প্রতিটি এলাকার নিবন্ধন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতামত এবং যাত্রী সাধারণের সঙ্গে গণশুনানি করে এলাকাভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “এক কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা, তিন দিনের মধ্যে? তাদের বিকল্প কী ব্যবস্থা? কোনো শব্দ নেই, কোনো বাক্য নেই, তারা কীভাবে বিজ্ঞ আদালত হয়। আদালতকে বললেই তো আদালত অবমাননা হয়। বাংলাদেশের আদালত ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আমার একটু কম। আমরা দেখেছি দুটি প্রধান বিচারপতিকে কীভাবে এই বাংলাদেশ থেকেই একবারে কান ধরে বের করে দেওয়া হয়েছে।
“এই যে বিজ্ঞ আদালত, তিনি যে মাত্র তিন দিন সময় দিয়েছেন, আমি এটার তীব্র সমালোচনা করছি। এটা কোনো অবস্থাতেই মানবিক, সংবেদনশীলতার মধ্যে এটি পড়ে না। এদের বিকল্প পুনর্বাসন কোথায়? এটি রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। এটি সরকারকে ভাবতে হবে। একুশ শতকে আপনি দেখবেন যেগুলোতে ব্যাটারি নেই, সেই রিকশাগুলো সম্পর্কে আমরা অতীতেও বলেছি।
“কতোটা অমানবিক, একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে টেনে নিয়ে যায়। দুজন মানুষ বা যাত্রীরা যখন রিকশায় বসে, তারা অনেক গোপন কথা বলে, অনেক স্ল্যাং কথা বলে, অনেকে প্রেমালাপ পর্যন্ত করে, একজন মানুষ যে চালায় তার সামনে, আমরা তার অস্বিত্বকে অস্বীকার করি।“
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “আমাকে একজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, এই যে তিন দিনের মধ্যে কোর্টের রায়, ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা সরিয়ে ফেলতে হবে, এর পিছনেও একটা উদ্দেশ্য আছে। এই উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো একটা কর্পোরেট কোম্পানি বা মালিকরা নতুন ধরনের থ্রি হুইলার বা অটো রিকশা আনতে চান। সেটা নাকি আরও সফিস্টিকেটেড, তার লাভের জন্য আরও ভালো। এই গরিবদের উচ্ছেদ করতে পারলে তার কোম্পানির অটো রিকশাগুলো এই রাস্তায় বসতে পারে। এখানে কর্পোরেট স্বার্থ, মালিকের স্বার্থ।”
রিকশা-ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন, চট্টগ্রাম ইলেক্ট্রিক থ্রি-হুইলার যানবাহন মালিক ও চালক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিদ্দিক মিয়াসহ সংগঠনের নেতারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।