আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পৃথক ভূমি কমিশন গঠন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেছেন নেতারা।
Published : 30 Aug 2023, 01:50 PM
দেশে আদিবাসীদের বিভক্ত করার ‘পাঁয়তারা’র পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে নানামুখী ‘চক্রান্ত চলছে’ বলে অভিযোগ করেছেন আদিবাসী পরিষদের নেতারা।
ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পৃথক ভূমি কমিশন গঠন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ কয়েকটি দাবি তারা তুলে ধরেছেন।
আদিবাসী পরিষদের দপ্তর সম্পাদক সুভাষ চন্দ্র হেমব্রম বলেন, “আদিবাসী পরিষদকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। সম্প্রতি আদিবাসী সভাপতিকে অব্যাহতি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচন করার সংবাদ আপনারা দেখেছেন।
“যারা এটা করেছেন তারা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির অনুমতি ছাড়া এই সভা কে আহবান করেছিলেন? সভায় কারা উপস্থিত ছিলেন? এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সারাদেশের কমিটিগুলোকে আহ্বান করা হয়েছিল কিনা? সভাপতির অনুপস্থিতিতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত কি নেওয়া যায়? ন্যূনতম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সাংগঠনিক নীতি মানলে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া কি সম্ভব?”
আদিবাসীদের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে ওই কমিটির কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করে সুভাষ চন্দ্র বলেন, “কিছু ব্যক্তির ইচ্ছায় এই কাজটি করা হয়েছে। বাস্তবে জাতীয় আদিবাসী পরিষদকে কোনো ব্যক্তির পকেট সংগঠনে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য যে, আদিবাসীরা যখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত, তখন কিছু ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আদিবাসী পরিষদকে ব্যবহৃত হতে দেওয়া যায় না।
“রাজশাহীতে বসে কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজশাহীতে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে, সেচের পানি না পেয়ে, অপমানিত হয়ে যখন আদিবাসী কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল তখন তারা কোথায় ছিলেন? এখন কমিটি করতে যত আগ্রহ, দিনাজপুরের স্বপ্নপুরীর জমি উদ্ধারের আন্দোলনে সেই পরিমাণ আগ্রহ দেখা যায়নি কেন? আসলে এর মধ্য দিয়ে আদিবাসীরা বিভক্ত হবে এবং ভূমি থেকে বিতাড়িত করার যে কৌশল চলছে, সেটিই শক্তিশালী হবে।”
‘ভূমি দখলের পাঁয়তারা’
লিখিত বক্তব্যে আদিবাসী পরিষদের দপ্তর সম্পাদক বলেন, “আদিবাসীদের ভাষা-সংস্কৃতি বিপন্ন, দারিদ্র্য কমছে না, শিক্ষার সুযোগ বাড়ছে না, নাগরিক অধিকার বিপন্ন, পুষ্টিহীনতা ব্যাপক, বেকারত্ব ভয়াবহ, সরকারের ঘোষিত মাথাপিছু আয় এবং আদিবাসীদের আয়ের মধ্যে পার্থক্য বিশাল, দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বলতে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলকেই বুঝানো হয়। আদিবাসীরা এখন পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদিবাসীদের ওপর ‘আক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম, দিনাজপুরে স্বপ্নপুরীর নামে ভূমি দখল, বগুরার শেরপুরে আদিবাসীদের ভূমি বেদখলের জন্য হামলা এবং বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে আদিবাসীদের বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে।
“অর্থনৈতিক জোন, ইপিজেড, ইকো পার্ক করার নামে আদিবাসীদের ভূমি দখলের নানা পাঁয়তারা চলছে। চা বাগানের আদিবাসীরা উদ্বেগ ও আতঙ্কের মধ্যে বাস করছে। এ সমস্ত কিছু চলছে শাসক দলের প্রশ্রয়ে এবং প্রশাসনের সহায়তায়। ফলে আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এবং প্রগতিশীল মানুষদের প্রতিবাদ গড়ে তোলা ছাড়া আদিবাসীদের অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব নয়।”
আদিবাসী হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের ঘটনা তুলে ধরে সুভাষ চন্দ্র সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আদিবাসী নেতা নওগাঁর আলফ্রেড সরেন, দিনাজপুরের ঢুডু সরেন, সাতক্ষীরার নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যার বিচার এখনও হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ যার নেতৃত্বে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ হয়েছিল সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা বুধু ওরাও দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
“গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে পুলিশের গুলিতে নিহত তিনজন সাঁওতাল হত্যার বিচার এখনও হয়নি, সেই হামলায় পঙ্গু হয়ে যাওয়া ৩২ জন এখনও মানবেতর জীবন যাপন করছেন।”
সরকার পরিবর্তন হলেও আদিবাসীদের ‘বঞ্চনার অবসান হয় না’ বলে মন্তব্য করেন সুভাষ চন্দ্র হেমব্রম।
আদিবাসী পরিষদের পাঁচ দাবি
>> ‘আদিবাসী’ হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃত দিতে হবে।
>> সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও মন্ত্রণালয় গঠন। শিক্ষা ও চাকরিতে কোটা নিশ্চিতকরণ।
>> গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার, রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি ‘আত্মহত্যার জন্য দায়ীদের’ বিচার।
>> আদিবাসীদের উপর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, জমি দখল, লুটপাট ও মিথ্যা মামলাসহ পুলিশি হয়রানি বন্ধ করা। আদিবাসীদের নামে বরাদ্দকৃত টাকা আত্মসাৎ ও ভূমি অফিসের ঘুষ দুর্নীতি হয়রানি বন্ধ করা।
>> পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা।
আদিবাসী পরিষদের তিন দশক পূর্তি এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টায় ঢাকার শাহবাগে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।
সংগঠনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাকেকুজ্জামান রতনসহ অন্য নেতারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।