সরকারি প্রতিষ্ঠানে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন হলে দুদকে অভিযোগ আসবে না বলে মনে করেন দুদক চেয়ারম্যান।
Published : 26 May 2024, 01:41 AM
অভ্যন্তরীণ ‘দুর্নীতি প্রবণতা’র ওপর নজরদারি, সৎ কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা, বিশেষ মামলা তদন্তে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনসহ সব কার্যালয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও কার্যকর করতে একটি সেমিনারে ১৯ দফা সুপারিশ এসেছে।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ-এইচআরপিবি আয়োজিত সেমিনারে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করার উদ্দেশে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, “দুর্নীতি রেখে উন্নয়ন হলে তা কখনও টেকসই হবে না। নাগরিকরা যদি দায়িত্ব পালনে সচেতন হন এবং পারিবারিক পর্যায়ে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখেন, তাহলে ফলাফল আশাপ্রদ হবে।
“অধিকাংশ অভিযোগে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য থাকে না, যার কারণে কোনো প্রমাণ না থাকায় মামলা দায়ের সম্ভব হয় না।”
সরকারি প্রতিষ্ঠানে যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা হয়, তাহলে দুদকে অভিযোগই আসবে না বলে মনে করে মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশের সভাপতি হুমায়ুন রশিদ বলেন, “বর্তমানে কতিপয় নতুন ব্যবসায়ী যারা আগে কখনও ব্যবসা করেননি তারা প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছেন। মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারী, আমলা, রাজনীতিবিদ অনেকেই জড়িত।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, “গবেষকরা শত বছর আগেই বলেছেন, দুর্নীতি হল আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। স্বাধীনতার তিন বছর পরেই বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিবাজদের বিষয় উপলব্ধি করে জনসভায় বলেছেন, চোররা সব খেয়ে ফেলছে।”
প্রাক্তন সংসদ সদস্য শামিম হায়দার পাটওয়ারী বলেন, “দুর্নীতির ছোট ঘটনা তদন্ত না করে বড় ঘটনা তদন্ত করা প্রয়োজন। ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে কিছু প্রভাবশালী সবচেয়ে বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটাচ্ছেন।”
সাংবাদিক জ ই মামুন বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে মিডিয়া দুর্নীতি প্রতিরোধে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না, কারণ ঢাল-তলোয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বিদ্যমান। প্রভাবশালীদের কারণে সাংবাদিকরা অনেক ক্ষেত্রে রিপোর্ট করতে ভয়ভীতির সম্মুখীন হচ্ছেন।”
এইচআরপিবি প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ বলেন, “দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে দুদক জনপ্রত্যাশা পূরণে সফল হয়েছে বলে মনে হয় না, কারণ রাঘব-বোয়ালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।
“ক্ষমতাসীনরা যদিও দুর্নীতির বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ এর কথা বলেন কিন্তু বাস্তবে তা নয়। ক্ষমতার আশপাশে থেকে অনেকেই দুর্নীতি করে গেলেও তা আমলে নেওয়া হয় না।”
সেমিনারের শুরুতে তিনি ১৯টি সুপারিশ তুলে ধরেন। এগুলো নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বক্তারা তাদের নিজস্ব মত-পথও তুলে ধরেন।
সভা পরিচালনা করেন এইচআরপিবি এর সাধারণ সম্পাদক ছারওয়ার আহাদ চৌধুরী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট একলাছ উদ্দিন ভুইয়া।
সুপরিশগুলো হল
• কমিশনের সদস্য সাতজন এবং লোকবল ৩ গুণ বাড়াতে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়া;
• দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনার ও কর্মকর্তাদের নির্দলীয় মনোভাব, সাহসী ব্যক্তিত্ব এবং দুর্নীতি দমনে অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে দুর্নীতি দমনে ভূমিকা রাখা;
• দল, মত, পেশা, এলাকা ও ব্যক্তি পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সমানভাবে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা নেওয়া;
• দুদকের প্রত্যেক মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে দুদকের আইন ও বিধি সুনির্দিষ্টভাবে অনুসরণ করা, ব্যত্যয় ঘটলে তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কমিশনের ব্যবস্থা নেওয়া;
• উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে সেক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও তদন্ত দ্রুতসময়ে শেষ করার ব্যবস্থা নেওয়া। প্রয়োজনে অনুসন্ধান বা তদন্ত মনিটরিং করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টিম গঠন করার ব্যবস্থা নেওয়া;
• দুদকে প্রেষণে পদায়নের ক্ষেত্রে তাদের চাকরি দুদকে ন্যস্ত করার বিধান করতে হবে। চাকরি করা অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তদন্ত ও শাস্তি দুদক আইনে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে;
• দুদকে কর্মরত সবার সম্পদের হিসাব ২ বছর পরপর জনগণকে অবহিত করার জন্য দুদকের ওয়েবসাইটে প্রকাশের ব্যবস্থা নিতে হবে;
• বিভিন্ন রিপোর্টে বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিষয়ে বলা হচ্ছে, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য সেসব রিপোর্ট সম্পর্কে দুদককে তদন্ত করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ;
• দুদকে কর্মরত যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসবে, তাদের বিষয়ে দুদকের তদন্তের পাশাপাশি গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তদন্ত থেকে তাদের তাৎক্ষণিক বিরত রাখা নিশ্চিত করা;
• দুদকে কর্মরত যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে অধিক গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ;
• টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় অনুসন্ধানী খবর প্রচারিত হলে সেসব বিষয় দুদকের সরাসরি অনুসন্ধানের ব্যবস্থা গ্রহণ;
• দুদকে মামলা দায়েরের পর আসামিকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়া;
• দ্রুতসময়ে মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত সমাপ্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া এবং যারা তা করতে পারবেন, তাদের পুরস্কৃত করা;
• কোটি টাকার উপরে দুর্নীতির অভিযোগে হওয়া মামলা তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে তিনি প্রভাবিত না হতে পারেন;
• বিভিন্ন আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য অধিকসংখ্যক দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কোনো আইনজীবী আসামি পক্ষের কাছ থেকে প্রভাবিত হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা;
• জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্য থেকে দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে পুরস্কার ও সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ;
• যে সব অনুসন্ধান, তদন্ত এক বছরের মধ্যে শেষ হচ্ছে না সেগুলো তালিকাভুক্ত করে কমিশনের তত্ত্বাবধানে দ্রুত শেষ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া;
• বিদেশে অর্থপাচার বা ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতে জড়িতদের তথ্য দুদকের কাছে এলে বা মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে কমিশনকে গুরুত্ব সহকারে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাদের ভ্রমণ, গাড়ি ব্যবহার, ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি বিধান সংযোজন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
• ইতঃপূর্বে অনেক দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে অনুসন্ধান না করায় ঢালাওভাবে অব্যাহতি পেয়েছেন এবং এ নিয়ে মিডিয়াতেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়ার তথ্য বিবেচনায় নিয়ে অব্যাহতিপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে থাকা নথি পুনরায় অনুসন্ধানের আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ।