ছায়ানটের নববর্ষ কথনে বলা হয়, পরাধীন আমলে, আপন সংস্কৃতিতে বাঁচবার সাহস যোগাতে বাংলা নববর্ষে শুরু হয়েছিল বাঙালির চিরকালীন সুরবাণীর এই আয়োজন।
Published : 14 Apr 2024, 09:14 AM
নববর্ষের নবীন আলোয়, নবীন আশায়, নবজীবন লাভ করে সম্প্রীতির সাধনায় নিজেদের নিমগ্ন করার প্রতিজ্ঞার মধ্য দিয়ে বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে সংস্কৃতি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছায়ানট।
রোববার বৈশাখের প্রথম দিন ভোরে আহীরভৈরব রাগে শিল্পী মর্তুজা কবির মুরাদের বাঁশির সুরে শুরু হয় রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। পরে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মেলক কণ্ঠে শোনান 'আঁধার রজনী পোহালো'।
একক কণ্ঠে 'বিমল আনন্দে জাগো রে' শোনান সত্যম্ কুমার দেবনাথ এবং তানিয়া মান্নান শোনান 'তোমার সুর শুনায়ে'।
একে একে গান আর পাঠে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে সুরের এই আয়োজন চলে দুই ঘন্টাব্যাপী। অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী নববর্ষের কথন পাঠ করেন।
ছায়ানটের নববর্ষ কথনে বলা হয়, পরাধীন আমলে, আপন সংস্কৃতিতে বাঁচবার সাহস যোগাতে বাংলা নববর্ষে শুরু হয়েছিল বাঙালির চিরকালীন সুরবাণীর এই আয়োজন।
“স্বাধীন দেশে বাঙালির নতুন সংকল্প আপন সংস্কৃতি অন্তরে ধারণ করে পূর্ণ মানব হয়ে ওঠা; আপন সত্তাকে জাগ্রত রেখে, শিক্ষিত ও সংস্কৃতি-সচেতন মানবিক জনপদ গড়ে তোলা। কিন্তু আজ, ভোগবাদ ও রক্ষণশীলতার দাপটে আমরা নতুন সংকটের সম্মুখীন। হারাতে বসেছি বাঙালির স্বাভাবিকতা। আলগা হয়ে পড়ছে পারস্পরিক সম্প্রীতির বাঁধন। বিস্তার ঘটছে লোভ এবং স্বার্থপরতার। চেনা মানুষও হয়ে উঠছে অচেনা। তৈরি হচ্ছে এক অস্বাভাবিক এবং অসহিষ্ণু সমাজ।”
আত্মবোধন-জাগরণের সুরবাণীতে নতুন বছরকে আবাহন
অমানবিক এই অস্বাভাবিকতা থেকে বেরোনোর আহ্বান জানিয়ে ছায়ানট বলছে, “নইলে বাঙালির প্রাণপ্রিয় এই নববর্ষ উদ্যাপনও হয়ে পড়বে কেবল একটি দিনের জন্য বাঙালি সাজবার উপলক্ষ্য।”
সম্প্রীতির সাধনায় নিজেদের নিমগ্ন করার প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি বলেন, “আজ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রভাতের সুরবাণী 'আঁধার রজনী পোহালো, জগত পুরিল পুলকে। নববর্ষের নবীন আলোয়, নবীন আশায়, নবজীবন লাভ করে সকলে যেন স্বাভাবিকতায় ফিরি এবং সম্প্রীতির সাধনায় নিজেদের নিমগ্ন করি-এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। শুভ নববর্ষ।”
ষাটের দশকে পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রমনার বটমূলে যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিল ছায়ানট, এখন তা বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া প্রতি বছরই এই আয়োজনটি করে আসছে ছায়ানট। কোভিডকালীন দুই বছর আয়োজনটি করা হয়েছিল ভার্চুয়ালি।
সেই ধারাবাহিকতার পথ ধরে এবারও গান, আবৃত্তি আর কথনে বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানায় ছায়ানট।
এবার অনুষ্ঠান সাজানো হয় নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম-দেশপ্রেম আর আত্মবোধন-জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। যোগ হয় জাতীয় কবির কালজয়ী সৃষ্টির বিজাতীয় অবমাননার প্রতিবাদ এবং লেখনীর দুর্দম শক্তিতে বাঙালির গণজাগরণে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে চলা আবু বকর সিদ্দিককে স্মরণ।
এবার আয়োজনে সম্মেলক গান ছিল ১১টি, একক গান ১৫টি এবং ছিল পাঠ ও আবৃত্তি।
দুই ঘন্টাব্যাপী এই আয়োজনে ভোরের পাখির কলতান আর সঙ্গীতের সুর যেন মিলে যায় একই প্রাণে। প্রকৃতিও যেন সুরের মায়াজালে আবাহন করে বাংলা নববর্ষকে। রমনার সবুজ চত্বরে ভেসে আসে সেই চিরচেনা গানের সুর।
অনুষ্ঠানে সম্মেলক কণ্ঠে শিল্পীরা শোনান- 'উদার অম্বর দরবারে তোরি', 'ওঠো ওঠো রে', 'এ পথ গেছে কোন খানে', 'বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা', 'নমঃ নমঃ নমো বাঙলাদেশ মম', 'বিপ্লবেরই রক্তরাঙা ঝাণ্ডা ওড়ে আকাশে', 'নাই নাই ভয়' গানগুলো।
একক কণ্ঠে এ টি এম জাহাঙ্গীর শোনান 'তিমির দুয়ার খোলো', শারমিন সাথী ইসলাম ময়না শোনান 'অধরা দিল ধরা এ ধুলার ধরণীতে', খায়রুল আনাম শাকিল শোনান 'প্রথম আলোক লহ প্রণিপাত', মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া শোনান আনো আনো অমৃত বারি'।
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় পাঠ করে শোনান 'ত্রাণ ও অপমানিত' এবং রামেন্দু মজুমদার পাঠ করেন 'জীবন-বিজ্ঞান'।
একক কণ্ঠে মনীষ সরকার গেয়ে শোনান 'মেঘ বিহীন খর বৈশাখে' এবং সেমন্তী মঞ্জরী শোনান 'ওরে বন তোর বিজনে'। এছাড়া তাহমিদ ওয়াসিফ ঋভু শোনান 'আমার মন চেয়ে রয়', বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী শোনান 'আমি বাউল হলাম', মুহাম্মদ কামরুল বাশার শোনান 'আমার সোনার বাংলায়'।
বড় ও ছোটদের দল সম্মেলক কণ্ঠে শোনায় 'এই না বাংলাদেশের গান' এবং 'কারার ঐ লৌহ কপাট' ও 'এই শিকল পরা ছল'।
একক কণ্ঠে বিমান চন্দ্র বিশ্বাস শোনান 'হিংসা আর নিন্দা ছাড়ো', চন্দনা মজুমদার শোনান 'মনেরে আর বোঝাই কতো'।
অনুষ্ঠানের শেষভাগে শিল্পীরা সম্মেলক কণ্ঠে শোনায় 'আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই'। পরে কথন এবং জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।