সাভার বাস স্ট্যান্ডে পরিত্যক্ত একটি জমিতে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন সাজেদা বেগম নামে এক নারী, হাতে মেয়ে খালেদা আক্তারের ছবি। কান্নার দমকে কথা বলতে পারছিলেন না তিনি।
Published : 24 Apr 2015, 01:37 AM
রানা প্লাজা ধসে ‘প্রকৃত’ নিখোঁজ ২৬১
সাভারে নিহতের সংখ্যা ১১শ’ ছাড়িয়েছে
রানা প্লাজাকে ভুলে থাকতে চান রেশমা
চারশ’ ঘণ্টা পর রেশমাকে জীবিত উদ্ধার
সংবর্ধনায় কাঁদলেন তারা, কাঁদালেনও
সাজেদা এসেছেন গোপালগঞ্জ থেকে, দুই বছর ধরে মেয়েকে খুঁজে ফিরছেন তিনি। যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে তিনি কাঁদছিলেন, ঠিক দুই বছর আগে এই স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ছিল নয় তলা একটি ভবন। ওই ভবনেই কাজ করতেন তার মেয়ে।
ভবনটি ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়েছিল, বহু মানুষের সঙ্গে চাপা পড়েছিলেন খালেদা। জীবিত উদ্ধার হননি এই তরুণী, পাওয়া যায়নি তার লাশও।
তাই ২৪ এপ্রিল ফিরে এলেই এই স্থানটিতে আসেন সাজেদা, রানা প্লাজা নামে ওই ভবনটির ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে এখন এই কান্নাটুকুই মেয়ের হারানোর সান্ত্বনা তার জন্য।
রানা প্লাজা, দুই বছর আগের এই ভবন ধস বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকেই ধসিয়ে দেওয়ার উপক্রম ঘটিয়েছিল প্রায়। সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু আর অসংখ্য শ্রমিকের পঙ্গুত্ব তখন সারা বিশ্বে আলোচনায় তুলে এনেছিল বাংলাদেশকে।
বিশাল সব ইট-পাথরের চাঁই তুলে, আর জীবনবাজি রেখে স্বেচ্ছাসেবীসহ উদ্ধারকর্মীরা কাজ চালালেও সবার সন্ধান মেলেনি ধ্বংসস্তূপ থেকে।
তেমনই একজন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার গংগারামপুরের খালেদা। স্বজনদের কাছে তিনি এখন জীবিত নন, তবে লাশ না পাওয়ায় মৃত ভাবতেও মায়ের মন সায় দেয় না।
ভবন ধসের দুই বছর পূর্তির একদিন আগে বৃহস্পতিবার তাই সাজেদার ছুটে আসা।
ধসে পড়া ভবনের পাঁচটি গার্মেন্টসের সাড়ে তিন হাজার শ্রমিকের মধ্যে খালেদা একজন। চতুর্থ তলার ফ্যান্টম এ্যাপারেলসের ফিনিশিং বিভাগে কাজ করতেন তিনি।
ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশ উদ্ধারের পর যাদের সনাক্ত করা যাচ্ছিল না, তাদের ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছিল।
“কয়েক দফায় ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিলেও মেয়ের কোনো খোঁজ পাইনি,” বলেন সাজেদা। সেই সঙ্গে জানান, মেয়ের হদিস না মেলায় কোনো সহায়তাও মেলেনি।
খালেদার মতোই আরেক শ্রমিক বাবু মিয়ার মা মেহেরান বেগম এখনও ধ্বংসাবশেষে হাড়গোড় উদ্ধারের খবর পেলেই টাঙ্গাইলের নাগরপুর থেকে ছুটে আসেন সাভারে।
বৃহস্পতিবারও মেহেরান এসেছিলেন, দুই বছর পর ধ্বংসস্তূপে এক টুকরো জিন্স পড়ে থাকতে দেখে অঝোরে কেঁদে ওঠেন। আর বলেন, “ওই দিন আমার বাবু এ রকম কাপড়ের প্যান্ট পরে কারখানায় গেছিল।”
ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার পরও ছেলেকে না পাওয়া এই নারী বলেন, “মনকে সান্ত্বনা দিতে এখানে বসে আছি।”
স্থানীয়রা জানান, রানা প্লাজার জমিতে এখনও পাওয়া যাচ্ছে মাথার খুলিসহ মানুষের হাড়গোড়। গত সোমবার সকালেও পথশিশুরা মাটির নিচে কিছু হাড়গোড় পেয়েছে। এরকম মাঝে মধ্যেই পাওয়া যায়, তা জড়ো করে রাখা হয় সেখানে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভের সামনে।
মাদারীপুর থেকে আসা হাজি মাতাব্বরকে দেখা গেলে পরিত্যক্ত ওই জমির মধ্যে কী যেন খুঁজছিলেন, জিজ্ঞাস করতে জানা গেলে, তার মেয়ে শাহিনুর বেগমও চাপা পড়েছিলেন সেদিন, কিন্তু লাশ পাননি।
ধামরাইয়ের ফোর্ডনগর এলাকার মরিয়ম বেগমও এসেছিলেন নিখোঁজ ছোট বোন নীলা আক্তারের ছবি হাতে। “দুই দুইটা বছর পার হয়ে গেলো, বোনটাকে কোথাও পেলাম না।”
একটি ভবন ধসের এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছে এই পরিবারগুলোকে।
দখল করে দোকানপাট
রানা প্লাজার এই জমি বিক্রি করে কিংবা একে ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের দাবি ওঠার পর তা সমর্থন করেছিলেন অনেকে।
কিন্তু তার কোনো সুরাহা হয়নি। আর এর মধ্যেই জমিটি ধীরে ধীরে দখল হতে দেখা যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা যায়, জেলা প্রশাসনের দেওয়া টিনের সীমানা প্রাচীর নেই। আদালতের লাগানো সাইনবোর্ডটিও ভেঙে পড়ে আছে। এ সম্পত্তি দেখভালের জন্য একটি পুলিশ ক্যাম্প ছিল, তাও এখন আর নেই।
স্থানীয়রা জানায়, যে যার সুবিধামতো দোকানঘর বসিয়ে ভাড়া দিচ্ছে। সামনে আবার ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার স্ট্যান্ডও হয়েছে।
আরেক চা দোকানি জয়নাল আবেদীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাসিক চুক্তিতে আলিম নামে এক ব্যক্তি তাকে ওই স্থানে বসিয়েছে।
তবে আলিমের কোন পরিচয় তিনি বলতে পারেনি।
সংরক্ষিত স্থানে দোকানপাট বসানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কেউ তো বাধা দেয় নাই।”
আরেক মুদি দোকানি মো. সোহেল জানান, মাসে ১৫শ’ টাকা চুক্তিতে বক্কর নামে এক ব্যক্তি দোকান ঘর তুলে বসতে দিয়েছে।
তবে সেও বক্করের নাম ছাড়া কোনো পরিচয় বলতে পারছে না।
দুই বছরেও নেই অভিযোগপত্র
রানা প্লাজা ধসের পর স্থানীয় যুবলীগ নেতা সোহেল রানার মালিকানাধীন এই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ একে একে বের হতে থাকে।
ভবন ধসের ঘটনায় দুই মামলা হয়। কিন্তু দুই বছরেও তদন্ত শেষ করে আলোচিত দুই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল হয়নি।
অথচ এক বছর আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, শিগগিরই তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
মামলার মোট ২১ আসামির মধ্যে প্রধান আসামি রানাসহ চারজন ছাড়া সব আসামি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন বলে আদালতের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়।
মামলা দুটির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর গত ১৬ এপ্রিল সময়ের আবেদন করলে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক কাজী শহীদুল হক তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ২১ মে নতুন তারিখ রেখেছেন।
ভবন ধসে প্রাণহানির ঘটনায় প্রথমে ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে মামলা করেন সাভার থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ। সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করা হয় এ মামলায়।
পরে মামলাটিতে অপরাধজনক প্রাণনাশের অভিযোগ আনা হয়। অপরাধজনক প্রাণনাশের অভিযোগ প্রমাণিত হলে এ মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
আর বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে রানাসহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে ইমারত বিধির মামলাটি দায়ের করেন সাভার মডেল থানায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল আহমেদ। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এ মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ দুই বছর শাস্তি হতে পারে।
এ পর্যন্ত আদালত ১৬ বার সময় দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন তৈরির জন্য। কিন্তু এতবার সময় নিয়েও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি তিনি।
ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবীর বাবুল সাংবাদিকদের বলেন, “তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে দেরি হওয়ার কারণেই চারজন ছাড়া সকল আসামি জামিনের সুবিধা নিতে পেরেছে।”
তদন্ত কর্মকর্তা বিজয়কৃষ্ণ কর বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফো ডটকমকে বলেন, “তদন্ত শেষ, আসামিদের তালিকাও তৈরি। তবে আসামিদের মধ্যে ১৩ জন সরকারি কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। তাই আটকে আছে।”
আর কতদিন সময় লাগবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত করেছি। আগামী তারিখে আশা করি দাখিল করতে পারব।”
তদন্ত কর্মকর্তা তার অনুসন্ধানের বিষয়ে বিভিন্ন সময় আদালতে বলেছেন, ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল ধরার পর ঝুঁকি জেনেও শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কাজ না করলে চাকরিচ্যুতির হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।
ভবনের নকশায় ত্রুটি, অনুমোদন না নিয়ে উপরের দিকে সম্প্রসারণ, নিম্ন মানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের তথ্যও এসেছে তদন্তে।
এ পর্যন্ত ১০০০ জনের জবানবন্দি নিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা বিজয় কৃষ্ণ ধর। তিনি বলেছেন, দুই মামলায় ৪০ জনকে আসামি করা হতে পারে।
দুই প্রকৌশলী দেশের বাইরে
ছয় তলার অনুমোদন নিয়ে নয় তলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত রানা প্লাজা নির্মাণে জড়িত দুই প্রকৌশলী চলে গেছেন বাংলাদেশের বাইরে।
ভবনটি নির্মাণকালে সাভার পৌরসভায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম এবং সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান দুর্নীতি করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
রানা প্লাজা ধসের আগেই শিক্ষাকালীন ছুটি নিয়ে ফারজানা ইসলাম চলে যান ইংল্যান্ডে। আর মাহবুবুর রহমান অস্ট্রেলিয়ায়। তারা এখনও ফেরেননি।
ভবন ধসের পর নির্বাহী প্রকৌশলী ইমতেমাম হোসেন ও সহকারী প্রকৌশলী আলম মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফাত উল্লাহসহ সাতজনকে বরখাস্ত করা হয়।
বরখাস্তের তালিকায় ফারজানা ও মাহবুবের নামও রয়েছে বলে জানিয়েছেন সাভার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র আয়নাল হক।