ফরিদপুরের নগরকান্দার পৌর মেয়র ও পলাতক বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, যার মধ্যে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে ছয় অভিযোগে।
Published : 13 Nov 2014, 09:53 PM
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।
বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের প্রারম্ভিক বক্তব্যের পর ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ১০৯ পৃষ্ঠার এ রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়ে শোনান। সবশেষে সাজা ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান।
প্রমাণিত দশ অভিযোগের মধ্যে ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দায়ে ফাঁসির রায় এসেছে।
এছাড়া ২, ৩, ৪ ও ১১ নম্বর অভিযোগে আটক, ধর্ষণ, ধর্মান্তর ও দেশান্তরে বাধ্য করা, মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পরামর্শ ও সহযোগিতার দায়ে তাকে মোট ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তবে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হওয়ায় খোকনকে আর জেল খাটতে হবে না। তার গ্রেপ্তার বা আত্মসমর্পণের পর এই সাজা কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক।
জাহিদ হোসেন খোকনের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় ১ নম্বর অভিযোগে আদালত তাকে খালাস দিয়েছে।
এই রায়ের বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যাবে। তবে সে সুযোগ নিতে হলে খোকন রাজাকারকে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
ছয় অভিযোগে ফাঁসি
অভিযোগ ৫: মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ মে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আইনাল রাজাকারসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে কোদালিয়া গ্রামের শহীদনগরে ঢোকে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাটের পরে আগুন দেয়। এ সময় আশেপাশে লুকিয়ে থাকা ৫০-৬০ জনকে ধরে এনে তাদের মধ্যে নারী ও শিশুসহ ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে খোকন ও তার সহযোগীরা। দেড় বছর বয়সী এক শিশুসহ অন্তত ছয়জন সে সময় গুরুতর আহত হন। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় আলাউদ্দিন নামে এক কিশোরের হাত ভেঙ্গে দেন খোকন। এছাড়া কোদালিয়া কওমি মাদ্রাসার কাছে পাকিস্তানি সেনারা আফজাল হোসেন এবং কাছেই এক পাটক্ষেতে শুকুর শেখ নামে একজনকে খোকন নিজে গুলি করে হত্যা করেন।
অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারা অনুযায়ী আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ৬: একাত্তরের ৩০ মে দুপুর দেড়টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাসহ রাজাকাররা ঈশ্বরদী গ্রামে যায় এবং বহু বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন দেয়। এ সময় গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকা ভীত ও নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের গুলি করে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। এতে সালাম মাতবর, শ্রীমতি খাতুন, লাল মিয়া মাতুব্বর ও মাজেদ মাতুব্বর নিহত হন।
অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার দায়ে এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারায় খোকনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ৭: একাত্তরের ৩১ মে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আসামির নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা কোদালিয়ার শহীদনগর গ্রামের দীঘলিয়া-ঘোড়ানাড়া বিলে যায় ২৯ মে ওই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানী সেনাদের লাশ খুঁজতে। এ সময় পিজিরউদ্দিন, তার ভাই আফাজ ও তাদের প্রতিবেশী শেখ সাদেকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারা তিনজনই বাড়ির ভেতরে পুড়ে মারা যান। একইদিন সকাল ১০টার দিকে বনগ্রামে আব্দুল হাই মোল্লা, ইকরাম মোল্লাসহ পাঁচজনের বাড়ি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। মেহেরদিয়া গ্রামের আসিরুদ্দিন মাতুব্বরকে মেহেরদিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করেন খোকন নিজে। পরে সফিজুদ্দিন মাতুব্বরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। গ্রামের বাড়িঘরে লুট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারায় খোকনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ৮: একাত্তরের ৩১ মে খোকনের নেতৃত্বে তার অধীন সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন, আওয়ামী লীগের কর্মী ও হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে গোয়ালদি গ্রামে যায়। এ সময় প্রাণভয়ে পালাতে থাকা মানুষের দিকে তারা গুলি চালালে রাজেন্দ্রনাথ রায় নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। পরিবারের সঙ্গে পালাতে থাকা কিশোর হান্নান মুন্সীর দুই বছরের বোন বুলু খাতুনকে তার মায়ের কোলে গুলি করে হত্যা করেন খোকন ও তার সহযোগীরা। অনেক বাড়িঘরে লুটপাটও চালানো হয়।
লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার দায়ে এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারায় খোকনকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ৯: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩১ মে খোকনের নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা পুরাপাড়া গ্রামে ঢুকে ছটু খাতুন, সফিজুদ্দিন শেখ, মানিক সরদার, রতন শেখ, জয়নুদ্দিন শেখ ও আব্দুল বারেক মোল্লাকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার দায়ে এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারায় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ১০: একাত্তরে ১ জুন ভোরে আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা এবং পাকিস্তানি সেনারা বাগত ও চুরিয়াচর গ্রামে গিয়ে বাড়ি বাড়ি লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগের সমর্থক মিনি বেগমের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মালেক মাতব্বর, ভাই মোশাররফ মাতব্বর, দাদী, নানী ও আমজাদ মুন্সীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া রতন মাতব্বর, আইয়ুব। আলী ও মঞ্জু রাণীসহ ১০/১৫জন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।
গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দায়ে এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারায় জাহিদ হোসেন খোকনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
কারাদণ্ড চার অভিযোগে
অভিযোগ ২: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৮ এপ্রিল থেকে ৬ মের মধ্যে কোনো একদিন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে আসামি খোকন ও তার নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী জঙ্গুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের কানাই লাল মণ্ডলসহ আরো একজনের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং গ্রামের অন্য হিন্দুরা মুসলমান না হলে বাড়িঘর ধ্বংস করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়। এরপর কানাই লালের পরিবারের কাছ থেকে জোর করে ৫ হাজার টাকা এবং জীবন দাসের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। আসামির সহযোগী আয়নাল রাজাকার, আতাহার রাজাকারসহ অন্যরাও গ্রামের অন্য হিন্দুদের হুমকি দিয়ে জোর করে টাকা আদায় করে।
অপরাধ সংঘটনের পরামর্শ ও সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ ঘটনায় খোকন রাজাকারকে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ৩: একাত্তরের ১৬ থেকে ২৮ মের মধ্যে কোনো একদিন আসামি খোকন ও তার ভাইয়ের নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকাররা একজন মৌলবিসহ জঙ্গুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের জীবন দাসের বাড়ি যায়। ওই বাড়ির আঙিনায় জীবন দাসসহ তার চার ভাইকে জোর করে মুসলিম করে তাদের মুসলিম নাম দেওয়া হয়। পরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে বাড়ির নারী সদস্যদেরও কলেমা পড়িয়ে মুসলিম করা হয়। এ ঘটনায় ভীত হয়ে নিজেদের কিশোরী মেয়েকে বাঁচাতে ১৮ থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো একদিন তারা সপরিবারে ভারত চলে যায়।
দেশান্তরে বাধ্য করা, মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ ঘটনায় খোকনকে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারায় ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ৪: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ মে সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে আসামি জাহিদ হোসেন খোকন, তার ভাই জাফর ও রাজাকার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা চাঁদের হাট গ্রামের বণিকপাড়ায় গিয়ে ১৬/১৭ জন হিন্দুকে হত্যার হুমকি দেয় এবং তাদের কাছ থেকে জোর করে সোনার গয়না ও নগদ অর্থ লুট করে। এরপর তাদের বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়। ওই গ্রামে আশ্রয় নেওয়া টগর দাস দত্তের স্ত্রী রাধা রাণী দাসকে ধর্ষণ করেন খোকন। অন্য রাজাকার সদস্যরা এ সময় খুকু রাণী দত্ত নামের আরেক কিশোরীকে ধর্ষণ করে। পরে সম্মান বাঁচাতে ধর্ষিতদের পরিবার ভারতে চলে যায় এবং সেখানেই থেকে যায়।
আটক, ধর্ষণ ও দেশান্তরে বাধ্য করার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় এ অভিযোগে খোকন রাজাকারকে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারায় ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ১১: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো একদিন আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে জঙ্গুরদিয়া-বাগুটিয়া গ্রামে কানাইলাল মণ্ডলের বাড়িতে যায়। কানাইলাল তাদের আসতে দেখে পাশের পাটক্ষেতে আত্মগোপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু খোকন রাজাকার সেখান থেকে তাকে ধরে এনে বাড়ির দক্ষিণ পাশের রাস্তায় নিয়ে গুলি করে। কানাইলালের ডান হাতে গুলি লাগলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান এবং ১৮ থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো একদিন ভারতে পালিয়ে যান।
দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ খোকনকে ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০(২) ধারায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এক অভিযোগে খালাস
অভিযোগ ১: একাত্তরের ২৭ এপ্রিল ভোর ৬টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে তার বড় ভাই জাফর ও সশস্ত্র রাজাকার সদস্যরা নগরকান্দা থানাধীন বনগ্রামে যায়। এরপর জাফরের উসকানিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই মোল্লা ও নাজিম উদ্দিন মোল্লার বাড়িসহ ছয় বাড়িতে লুটপাট চালায়। এছাড়া উমেদ মোল্লা, রতন মোল্লা, হাসেম মোল্লা, মো. ইউনুস মোল্লাসহ ১৯ জনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে সাত্তার মোল্লা ও আজিজ শেখকে সামান্য নির্যাতনের পরে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকি ১৭ জনকে থানায় নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। দুই দিন পর স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের মাধ্যমে পরিবারের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় খোকনের বিরুদ্ধে আনা অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছে আদালত।