রাজধানীর আদাবরে ছয়তলা ভবন থেকে পড়ে যাওয়ার আগে দমকল বাহিনী ও পুলিশের উপস্থিতিতে গৃহকর্মী মোসলেমা বেগম আধা ঘণ্টা কার্নিশে থাকলেও তাকে উদ্ধারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
Published : 01 Oct 2014, 11:43 PM
স্থানীয়রা এই অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি দাবি করেছেন, পুলিশের ‘তৎপরতার’ কারণে তারাও মেয়েটিকে বাঁচাতে কোনো চেষ্টা চালাতে পারেননি।
তবে স্থানীয়দের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সেখানে থাকা দমকল বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের চেষ্টার কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু তারা সফল হওয়ার আগেই মেয়েটি পড়ে যায়।
আর পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু দমকল বাহিনী উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছিল, তা নির্বিঘ্ন করতে ওই স্থানটিতে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না তারা।
মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে আদাবর থানার শেখেরটেকের জনতা হাউজিংয়ের ২ নম্বর রোডের ৩৭ নম্বরে ৬ তলা বাড়ি থেকে পড়ে মারা যায় গৃহকর্মী মোসলেমা।
১৬ বছরের এই কিশোরী তার বড় বোন শুকতারার (২০) সঙ্গে ওই বাড়ির ষষ্ঠ তলার বাসিন্দা ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা মোস্তফা খায়েরের বাসায় কাজ করতেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার বেগমনগর গ্রামের আলমাস হোসেনের মেয়ে শুকতারা এক বছর আগে ওই বাড়িতে কাজ নেন। চার মাস আগে নিয়ে আসেন ছোট বোনকে।
১২ বছর বয়সী জমজ দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে থাকেন খায়ের। তার বড় ছেলে থাকেন বিদেশে।
মঙ্গলবার মোসলেমার মৃত্যুর সময় গৃহকর্তা খায়ের ঢাকার বাইরে ছিলেন। বাড়িতে দুই সন্তানকে নিয়ে তার স্ত্রী ছিলেন বলে বাড়ির দারোয়ান মো. শিপলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
বাড়ির বাসিন্দারা পুলিশকে জানিয়েছে, সন্ধ্যায় ছাদ থেকে কাপড় আনতে গিয়েছিল মোসলেমা। অনেকক্ষণ পরও সে না ফেরায় শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, ছাদের কার্নিশে পা ঝুলিয়ে বসে আছে ওই কিশোরী।
বাড়ির লোকরা জানিয়েছেন, মোসলেমাকে কার্নিশে দেখার পর তারা থানায় এবং দমকল বাহিনীতে খবর পাঠান। তারা এসেছিলেনও, কিন্তু মেয়েটিকে বাঁচাতে পারেননি।
গৃহকর্তা মোস্তফা খায়েরের ছোট ভাই মুরাদ খায়ের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়ার পর তারা এসে আধা ঘণ্টার বেশি সময় বাসায় অবস্থান করছিল। কিন্তু মেয়েটিকে তারা উদ্ধার করতে পারেননি। এটি সত্যিই কষ্টকর।”
ওই বাড়িরই চতুর্থ তলায় থাকেন মুরাদ, তাদের আরেক ভাই মর্তুজা খায়ের পঞ্চম তলায় থাকেন।
ভবনটির উল্টো দিকের একটি বহুতল বাড়ির তৃতীয় তলার বাসিন্দা শিউলী বেগমও মেয়েটিকে কার্নিশে অনেকক্ষণ থাকতে দেখেছিলেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “চোখের সামনে বাচ্চা মেয়েটিকে কার্নিশ থেকে পড়ে যেতে দেখলাম। আধা ঘণ্টাখানেক মেয়েটি জীবিত অবস্থায় সেখানে ছিল।
“দমকল বাহিনীর লোকেরা থাকলেও উদ্ধারে এগিয়ে যায়নি। তারা ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে মেয়েটিকে দেখছিল। অথচ আমি ভাবছিলাম, আমরা এলাকার মেয়েরা যদি মশারি ও কম্বল নিয়ে নিচে দাঁড়াতাম মেয়েটিকে বাঁচাতে পারতাম।”
সেই পরিকল্পনার পথে পুলিশ বাধা ছিল দাবি করে শিউলী বলেন, “পুলিশ কাউকে সেখানে যেতে দিচ্ছিল না।”
তাদের এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে ঘটনার দিন সেই বাসায় থাকা মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক গৃহকর্মী অভিমান করে ছাদের কার্নিশে বসে আছে বলে খবর পাওয়ার পর তারা রাত সাড়ে ৮টায় ওই বাড়িতে যান।
“সেখানে গিয়ে খেয়াল করি, মেয়েটির পুরোপুরি জ্ঞান ছিল না। তাই তার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সে সাড়া দিচ্ছিল না। তাকে কেউ অচেতন করে সেখানে রেখেছে বলে মনে হয়েছে।”
বিপরীত পাশের ভবনের বাসিন্দা শিউলী বেগমও বলেন, “মেয়েটি পা নাড়াচ্ছিল, ঘাড় কাত করছিল। তবে মনে হচ্ছিল সে ঝিমাচ্ছে।”
মোহাম্মদ আলী বলেন, সরু কার্নিশে বসে থাকা মেয়েটির সাড়া আশা করছিলেন তারা। সেই চেষ্টা চালানোর মধ্যেই মেয়েটি হাত-পায়ের আঙুল নাড়ানো শুরু করে। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মেয়েটি পড়ে যায়।
“শুকতারা চিৎকার করে বলছিল, আপনারা আমার বোনকে বাঁচান, বোনকে বাঁচান।”
এই কিশোরীকে উদ্ধার করা কঠিন ছিল না বলে মনে করেন রিপন।
“আমরা ওকে (মোসলেমা)উদ্ধার করার চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম। তা কঠিন ছিল না। কিন্তু বাসার মালিকের স্ত্রী তা করতে নিষেধ করেন।”
মোসলেমাকে কার্নিশ থেকে উদ্ধারে দেরি হওয়ায় তার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বরাবরই ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
সেক্ষেত্রে পড়ে গেলে তাকে বাঁচাতে নিচে দমকল বাহিনীর কোনো তৎপরতা ছিল না বলে তাদের অভিযোগ।
ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তাক্ত মোসলেমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মোসলেমা কিভাবে গেল?
এই কিশোরী ছাদের রেলিং পেরিয়ে কিভাবে সরু ওই কার্নিশে গেল, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না কারো কাছ থেকেই।
ভবনটির ছাদে গিয়ে দেখা যায়, ছয় তলা ভবনের ওপরে এক পাশে ছাদ, অন্য পাশে একটি বড় কক্ষ, যেখানে ব্যায়ামের বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে।
খোলা অংশের পাশেই কার্নিশে ছিল মোসলেমা। ছাদ থেকে ১০ ইঞ্চি প্রস্থের ওই কার্নিশটির দূরত্ব কয়েক ফুট, সেই সঙ্গে রেলিংও রয়েছে।
প্রায় ৫ ফুট উচ্চতার মোসলেমাকে যদি নিজে ওই কার্নিশে নামতে হয়, তাহলে রেলিংয়ের ওপর দিয়ে বেয়ে নামতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব। আবার লাফ দিয়ে ১০ ইঞ্চি সরু ওই কার্নিশে অবস্থান নেওয়াও সম্ভব নয় বললেই চলে।
মোসলেমাকে দেখে তার সেখানে অবস্থান নেওয়াটা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে দমকল বাহিনীর কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলীর কাছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, কেউ তাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল। মারা গেছে ভেবে কৌশলে ছাদের কার্নিশে রেখে দেয়।”
গ্যারেজের কর্মী প্রত্যক্ষদর্শী রিপনও বলেন, “মোসলেমাকে নাম ধরে অনেকেই ডাকছিল। তবে সে সাড়া দিচ্ছিল না। ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছিল।”
তবে মোসলেমার এই ঝিমিয়ে পড়ার কারণ নিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে।
মৃত্যুর পর বোন শুকতারা রাতে আদাবর থানায় অপমৃত্যুর যে মামলাটি করেছেন, তাতে বলা হয়েছে-কাপড় আনতে যাওয়ার কথা বলে মোসলেমা ছাদের চাবি নেয় বোনের কাছ থেকে। আধ ঘণ্টায়ও ফিরে না আসায় গৃহকর্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়।
“এরপর খোঁজাখুঁজি করে দেখা যায়, মোসলেমা ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দুই পা ছড়িয়ে আছে। কোনও শব্দ করছে না, কোনও কথার জবাবও দিচ্ছে না।”
মোসলেমার লাশ নিয়ে বুধবার সকালেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে গেছেন বড় বোন শুকতারা। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও দমকল কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলীর সন্দেহ।
তিনি দাবি করেন, তারা যখন মোসলেমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন শুকতারাকে হাসপাতালে যেতে দেয়নি বাসার মালিকরা।
“ঘটনা আড়াল করতে শুকতারাকে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। তার ফোন নম্বরও কাউকে দেওয়া হচ্ছে না,” বলেন মোহাম্মদ আলী।
এই বিষয়ে মোসলেমার গৃহকর্তার ছোট ভাই মারুফ খায়ের বলেন, “মেয়েটির পরিবারই শুকতারাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিল বলে তাকে পাঠিয়ে দেই। তাকে এই সময়ে এখানে রেখে দেওয়াটা তো মানবিক হত না।”
মোসলেমার এই মৃত্যুতে ওঠা নানা প্রশ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে আদাবর থানার ওসি গাজী রুহুল ইমাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা সব কিছু খতিয়ে দেখবেন।
“আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। এ মৃত্যু নিয়ে থাকা রহস্যগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে।”