যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় না হওয়ার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় গণজাগরণ আন্দোলনের সূচনা পর্বে লাখো মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল শাহবাগে।
Published : 21 Sep 2014, 09:41 PM
তার দেড় বছর পর যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমে আমৃত্যু কারাদণ্ডের প্রতিক্রিয়া একই স্থানে বিক্ষোভে মানুষের সংখ্যা ছিল হাজার খানেক, আর তারাও ছিলেন তিন ভাগে বিভক্ত।
দেড় বছরে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গণজাগরণ আন্দোলনের বর্তমান দুর্বল অবস্থার কারণ হিসেবে বিভক্তির কথা স্বীকার করেছেন তিন অংশের নেতৃত্বদাতারাই।
তবে এই বিভক্তির দায় নিতে কোনো পক্ষই রাজি নয়। ইমরান এইচ সরকারের দাবি, মঞ্চকে দুর্বল করতে এটা সরকারেরই কৌশল। অন্য দুই পক্ষের অভিযোগ আবার ইমরানেরই বিরুদ্ধে।
কাদের মোল্লার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের এক অবস্থান কর্মসূচি থেকে সূচনা ঘটে শাহবাগ আন্দোলনের।
তখন থেকে এই মঞ্চের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ইমরান। তার নেতৃত্বেই আন্দোলন চলে আসছিল।
এরপর কয়েক মাস আগে শাহবাগে একদিন মারামারির পর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ড নেতা কামাল পাশা চৌধুরী আলাদাভাবে গণজাগরণ মঞ্চ নামে কর্মসূচি পালন শুরু করেন।
এই দুই পক্ষের বাইরে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু ‘শাহবাগ আন্দোলন’ নামে আলাদা ব্যানার নিয়ে কর্মসূচিতে নেমেছেন।
সাঈদীর আপিলের রায় দেওয়ার পর গত শুক্রবার বিক্ষোভের সময় সংঘর্ষেও জড়াতে দেখা গেছে তিন পক্ষকে। বিভক্তির কারণে আন্দোলন দুর্বল হওয়ার কথা মেনে নিলেও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারছেন না সংগঠকরা।
ইমরানের অভিযোগ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সরকারের ‘সমঝোতা’ হওয়ায় সরকার সমর্থক সংগঠনগুলোকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে এ বিভাজন তৈরি করা হয়েছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার যেহেতু সমঝোতার একটি রায় দেওয়ার কথা আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছে, তাই বছরের শুরু থেকেই শাহবাগকে দুর্বল করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ কাজ করতে গিয়ে সরকার প্রথমেই বেছে নিয়েছে তাদের সমর্থক সংগঠনগুলোকে।”
“অবশ্যই এ বিভাজনের কারণে আন্দোলনের ওপর খুবই বাজে প্রভাব পড়ছে। এটাই কিন্তু সরকারের কৌশল ছিল। সরকার চাচ্ছে যে আন্দোলন নিয়ে জনগণের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হোক, হতাশা তৈরি হোক, যেন তারা আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”
গণজাগরণ আন্দোলনের সূচনায় সরকার প্রধান শেখ হাসিনাও তাদের দাবিগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করেছিলেন, শাহবাগে বিভিন্ন সমাবেশে উপস্থিত হতেন মন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মী।
এখন ইমরানদের এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় সরকারি দলগুলোর নেতারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ‘আঁতাতের’ অভিযোগ নাকচ করার পাশাপাশি অভিযোগকারীদের ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইমরান নেতৃত্বাধীন গণজাগরণ মঞ্চে বামপন্থি অধিকাংশ ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এছাড়া সংগঠকের ভূমিকায় শুরু থেকে যে ব্লগাররা ছিলেন, তারাও রয়েছেন।
সরকার সমর্থক তিন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী শুরুতে মঞ্চের কার্যক্রমে সক্রিয় থাকলেও এখন সরে এসেছে।
এদের মধ্যে আলাদা ব্যানার নিয়ে সক্রিয় ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বিভাজনের জন্য ইমরানের ‘স্বেচ্ছাচারিতা, স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ ও অগণতান্ত্রিক মনোভাব’কে দায়ী করেছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত নির্বাচনের আগ থেকে বিভিন্ন মতপার্থক্য মঞ্চকে দ্বিখণ্ডিত করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। আমরা সে সময় থেকে অভ্যন্তরীণ ফোরামে বারবার আলোচনা করে এ সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম।
গণজাগরণ মঞ্চের বিভাজনের বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্য হয় চলতি বছরের ১২ এপ্রিল।
নিজেদের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক দাবি করে ইমরানকে মুখপাত্রের দায়িত্ব থেকে বাদ দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনে থাকা কয়েকজন।
ওই সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ড নেতা কামাল পাশা চৌধুরীকে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কামাল পাশাকে এই আন্দোলনে দেখা গেলেও মঞ্চের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া কিংবা মঞ্চে বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি।
কামাল পাশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সংবাদ সম্মেলন করেও বলেছিলাম যে আমরা নেতৃত্বে পরিবর্তন চাই, এজন্য মুখপাত্রের পদ থেকে ইমরান এইচ সরকারকে আমরা অব্যাহতি দিয়েছি। সে সেটা গ্রহণ না করে আলাদা প্ল্যাটফর্ম করেছে, এ কারণেই এখানে দুটো ভাগ।
“এখানে যেহেতু একটা বিভেদ তৈরি হয়েছে, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আস্থা হারাবে। এতে আন্দোলনের ক্ষতি হবে।”
কামাল পাশার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কর্মসূচিতে দেখা যায়।
ঐক্যের উদ্যোগ ব্যর্থ
সাঈদীর আপিলের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় গত বুধবার শাহবাগে অবস্থান নিতে গেলে কাঁদুনে গ্যাস এবং জলকামান থেকে পানি ছুড়ে ইমরান নেতৃত্বাধীন গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের হটিয়ে দেয় পুলিশ।
তখন ইমরান আহত হওয়ার পর আন্দোলনের সংগঠকদের পক্ষ থেকে সমঝোতার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বাপ্পাদিত্য বলেন, “আমরা দফায় দফায় দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে উদ্যোগ সফল হয়নি।”
“কর্মসূচি চলার সময়ে মাইকে বলেছি, যে সংগঠনগুলো আছে তাদের বলেছি, যে কোনো উপায়ে আমরা কথা বলতে রাজি আছি। আমাদের পক্ষ থেকে ঐক্যের বিষয়ে কোনো সমস্যা নাই।”
সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার জন্য ইমরানকে দায়ী করে তিনি বলেন, “আমরা ডাকলেই কি তারা (ইমরান) আসবে? আসবে না।
“আপনারা যদি বলেন, আপনারা ডাকলে আসবে; আমি এখনি গিয়ে ডাকব, আসো ভাই, আমরা এক সাথে হই। এটা তাকে (ইমরান) জিজ্ঞেস করেন, কেন আসবে না?”
তবে ইমরান দাবি করেন, ঐক্যের প্রস্তাবনার বিষয়ে তাকে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
“তারা যেহেতু আমার সাবেক সহযোদ্ধা, তাদের প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় তারা যেটা বলেছে যে আমাকে তারা এ রকম প্রস্তাব দিয়েছে, এটি কিন্তু সত্য নয়। আমার সাথে এ ধরনের কোনো আলোচনা হয়নি।”
তবে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটি আলোচনা হয়েছে বলে জেনেছেন ইমরান।
“কিন্তু সে আলোচনা শেষ হয়ে যায়নি। সেটি কিন্তু এখনও চলছে। সুতরাং সতর্কভাবে হোক বা অসতর্কভাবে হোক, এ মিথ্যা অভিযোগটি তারা করেছে।”
আলাদাভাবে আন্দোলন চললে তাতে আগের মতো জনগণ সাড়া দেবে কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি সংগঠকরা।
ইমরান বলেন, “জনগণকে সতর্ক হতে হবে। আমাদের যে ছয় দফা দাবি, এ দাবির প্রশ্নে কিন্তু কারো সাথে বিরোধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এ দাবি যে বিশ্বাস করে সেই শাহবাগে এসে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।
“আমরা নতুনভাবে ভাবছি কিভাবে আরো কৌশলী হয়ে আন্দোলন পরিচালনা করা যায়।”
ঐক্য না হলে আন্দোলন কিভাবে পরিচালনা করবেন- জানতে চাইলে কামাল পাশা বলেন, “ঐক্য না হলে যে আমরা আন্দোলন ছেড়ে চলে যাব, বিষয়টা তা নয়। ঐক্য না হলে ঐক্য ছাড়াই আন্দোলন করতে হবে।
“আমরা যারা এখানে আন্দোলন করছি, তারা কিন্তু শুধু ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে না, সেই জাহানারা ইমাম যখন আন্দোলনে নেমেছিলেন, তারও আগে থেকে আন্দোলন করে আসছি। আন্দোলনে আমরা ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।”