তিন বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে চতুর্থ বার হাই কোর্টে জামিন আবেদনের সময় তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেন আগের তথ্য গোপন করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
Published : 06 Aug 2014, 11:08 PM
নিজের কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির মামলায় হাই কোর্টে চতুর্থ দফায় জামিন আবেদন করে তাতে সফল হয়ে ইতোমধ্যে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন দেলোয়ার।
বেতনের দাবিতে তোবা গ্রুপের পাঁচটি কারখানায় শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে গত ২৪ জুলাই হাই কোর্ট থেকে জামিন নেন দেলোয়ার, যে আবেদনে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার অঙ্গীকার করেন তিনি।
দেলোয়ার মুক্ত থাকলে শ্রমিকদের বেতন নিয়ে জটিলতা হত না বলে পোশাক শিল্প মালিকরা বলে আসছিলেন। অন্যদিকে শ্রমিকদের অভিযোগ, দেলোয়ারের মুক্তির জন্যই তাদের বেতন নিয়ে জটিলতা তৈরি করা হয়েছে।
দেলোয়ারের জামিন আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের কথা বলে এলেও এখনো সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার পক্ষ; যদিও সে দাবি উঠেছে শ্রমিক সংগঠনগুলোসহ বিভিন্ন মহল থেকে।
২০১২ সালে তাজরীন গার্মেন্টেসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মৃত্যুর মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর জামিনের আবেদন নিয়ে হাই কোর্টের তিনটি বেঞ্চে গিয়েছিলেন দেলোয়ার।
এর মধ্যে একটিতে তিনি আবেদন ফেরত এনেছেন। একটিতে রুলও হয়েছে, যা উপস্থাপিত হয়নি মর্মে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট আদালতের আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
হাই কোর্ট রুলস অনুসারে পূর্ববর্তী সব আবেদনের কথা সর্বশেষ আবেদনে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক হলেও দেলোয়ার তা করেননি বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন।
আন্দোলনরত শ্রমিকদের বেতন দেয়ার অঙ্গীকার করার পর সর্বশেষ আবেদনে গত ২৪ জুলাই হাই কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ এবি মাহমুদুল হক ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের বেঞ্চ দেলোয়ারকে জামিন দেয়।
ওই আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিউল বাশার ভাণ্ডারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের আদালতে নতুন একটি আবেদন হিসাবে জামিন চাওয়া হয়। পূর্ববর্তী কোনো আদালতে আবেদন করা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যদি এর আগে কোনো আদালতে জামিন চাওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সেটা উল্লেখ না করার কারণে জামিনে তথ্য গোপন হয়েছে। তাহলে অবৈধভাবে এই জামিন নেয়া হয়েছে।”
হাই কোর্ট রুলসের ৪ নম্বর চ্যাপ্টারে ‘জেনারেল রুলস ফর অ্যাপ্লিকেশন অ্যান্ড অ্যাভিডেভিট’র বিধি-৬ এ এই কথা বলা হয়েছে, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে বা কোনো আদালতে যে কোনো বিষয়ে কোনো ধরনের আবেদন করার ক্ষেত্রে যদি একই ফলাফল চেয়ে বা একই বিষয় বা কাছাকাছি বিষয়ে পূর্বে কোনো আবেদন করা হলে সেই আবেদনের সারবত্তা ও সে বিষয়ে আদালতের আদেশ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
তাজরীন মালিক দেলোয়ারের পক্ষে এই মামলায় আদালতে লড়েন আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন। টেলিফোন বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি, যিনি বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন বলে একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন।
বিধির বিষয়ে কথা বলা হলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার একেএম শামসুল ইসলাম বলেন, “এই বিধি দেখে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, পূর্ববর্তী আবেদনের কথা উল্লেখ না করে কেউ আবেদন করতে পারেন না। তবে অন্য বিধান রয়েছে কি না, সেটা না দেখে বলা যাবে না।”
আদেশের অনুলিপি ‘পায়নি’ রাষ্ট্রপক্ষ
দেলোয়ারের জামিনের খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিউল বাশার আপিলের প্রস্তুতি নেয়ার প্রস্তুতির কথা জানালেও এখনো তাতে অগ্রগতি নেই।
জামিনের অনুলিপি দেখিয়ে কারাগার থেকে দেলোয়ার বেরিয়ে এলেও ওই একই অনুলিপি এখনো পায়নি বলে বুধবার জানিয়েছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা জামিন আদেশের কপি এখনো হাতে পাইনি। আমরা কপির জন্য আবেদন করেছি। তবে এখনো হাতে না পাওয়ার আপিলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।”
“কপি পেলে বিচার বিশ্লেষণ করব। তাতে আপিল করা প্রয়োজন করলে আমরা সেটা করব,।বলেন সরকারের এই আইন কর্মকর্তা।
দেলোয়ারের মুক্তির আগেও এ বিষয়ে কথা হয় মুরাদ রেজার সঙ্গে, মাহবুবে আলম বিদেশে থাকায় যিনি বর্তমানে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করছেন।
দেলোয়ারের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোসহ অনেকে তীব্র অসন্তোষ জানালেও মুরাদ রেজা বলেছিলেন, “কারাগার থেকে বের হয়ে গেলেও সেটা কোনো সমস্যা না। হল-মার্কের জেসমিন ইসলাম বের হয়েছিল। আবার আদালত আদেশ দিয়েছে, তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন।”
আদেশের অনুলিপি পাওয়ার আগেই স্থগিতের আবেদন করা যায় কি-না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তা যায়। তবে আমরা কপি দেখেই করতে চাই, সেটাই ভালো।”
দেলোয়ার কারাগার থেকে বের হয়ে গেলে আত্মসমর্পণেরর জন্য আদালতের নির্দেশনা চাইবেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
জামিনের আদেশের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিউল বাশার গত ৩ অগাস্ট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আমরা অবশ্যই এই জামিনে স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিল করব।
“আপিলের কাজ চলছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কাজ করছেন। তবে কবে ফাইল হচ্ছে, সেটা এখনি বলা যাচ্ছে না।”
অগ্রগতি জানতে চাইলে বুধবার তিনি বলেন, “আমি জামিনের জন্য নোট (অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে) দিয়েছি। কাজ চলছে, এর বেশি আমাকে কিছু জানানো হয়নি।”
আপিল বিভাগে এ ধরনের আবেদন দায়ের করতে হলে একজন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডের মাধ্যমে করতে হয়।
এ ধরনের কোনো আইনজীবীকে এই মামলায় নিয়োগ করা হয়েছে কি না- প্রশ্ন করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে থাকা মুরাদ রেজা বলেন, “সব তো আপনাদেরকে বলে দেয়া যাবে না।”
দেলোয়ার মালিকানাধীন আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই শতাধিক শ্রমিক আহত ও দগ্ধ হন।
ওই ঘটনার মামলায় গত ২২ ডিসেম্বর কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার, তার স্ত্রী ও কোম্পানির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তারসহ ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।
তাতে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ এবং ‘অবহেলার কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ আনা হয়।
দেলোয়ার ব্যর্থ হলেও তোবা গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদা পরে জামিনে মুক্তি পান।
তাজরীন ফ্যাশনস ছাড়া উত্তর বাড্ডার হোসেন মার্কেটে তোবা গ্রুপের অন্য পাঁচটি কারখানায় ১ হাজার ৬০০ শ্রমিক কাজ করেন।
বেতন বকেয়া পড়ায় আন্দোলন করে আসছিলেন তোবা গ্রুপের ১৬০০ শ্রমিক। এক পর্যায়ে ঈদের আগের দিন ২৮ জুলাই বাড্ডায় কারখানা ভবনে অনশনে বসেন তারা।
আন্দোলনরত শ্রমিকরা তাজরীনে শ্রমিকদের প্রাণহানির জন্য দেলোয়ারের শাস্তিও দাবি করে আসছেন। একই দাবির সঙ্গে তোবা শ্রমিকদের পাওনা আদায়ে মঙ্গলবার রাজধানীতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন বিশিষ্টজনরা।