আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ‘অস্ত্রের জোরে’ ক্ষমতায় রয়েছে মন্তব্য করে ‘আলোচনার মাধ্যমে’ অবিলম্বে নতুন নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
Published : 20 Jan 2014, 03:47 PM
নির্বাচনের পর বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘর-বাড়িতে হামলার ঘটনায় সরকারকেই দায়ী করেছেন তিনি।
সোমবার বিকালে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ভোটে নয়, অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় রয়েছে। তারা জবরদখল করে ক্ষমতায় আছে।
“সরকারকে বলব, গায়ের জোরে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকবে, তা জনগন মেনে নেবে না। এখনো সময় আছে, অতি দ্রুত আলোচনা করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা নিন।”
ভোটের পর বিএনপির প্রথম এই সমাবেশে নিজেই সভাপতিত্ব করেন খালেদা জিয়া। এক ঘন্টার বক্তৃতার শুরুতেই তিনি দাবি করেন, ৫ জানুয়ারির ‘প্রহসনের নির্বাচন’ জনগণ মেনে নেয়নি। এজন্য তিনি দেশবাসীকে ধন্যবাদও জানান।
খালেদা বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনই প্রমাণ করেছে, নির্দলীয় সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না।”
খালেদা জিয়া তার দীর্ঘ বক্তৃতায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও সরকারের ‘বৈধ্তা’ নিয়ে বার বার প্রশ্ন তোলেন এবং দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরে আলোচনা ও নতুন করে ভোট আয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন।
ভোটের আগে সর্বশেষ গত ২৫ অক্টোবর এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে তিনি সরকারকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে সময় বেঁধে দিয়ে ৬০ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা করেছিলেন।
বিএনপির বিরোধিতার মধ্যেই ভোট হয়ে যাওয়ার পর গত ১৫ জানুয়ারি গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে ২০ জানুয়ারির এই সমাবেশ এবং মহানগর-জেলা-উপজেলায় গণসমাবেশ ও শোভাযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সোহরাওয়ার্দীতে বিএনপির এই সমাবেশে ১৮ দলীয় জোটের শরিক নেতারা উপস্থিত থাকলেও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর কোনো নেতাকে এদিন দেখা যায়নি। জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের কোনো তৎপরতাও এদিন সমাবেশস্থলে চোখে পড়েনি।
প্রথমে ইনকিলাব ও পরে প্রথম আলোর ৬ জানুয়ারির সংখ্যা তুলে ধরে বক্তব্যের প্রথম দিকে খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘ যারা ভোটার, তারা সেদিন ভোটকেন্দ্রে যাননি। জনগণ নিরবে প্রত্যাখ্যান করেছে।’’
প্রথম আলোর সেদিনের শিরোনাম পড়ে শুনিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন- এই সরকার ‘কলঙ্কিত’ সরকার।
“নির্লজ্জ সরকারকে বলব, অবিলম্বে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করুন।”
খালেদা জিয়া বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে দেশে স্থিতিশীলতা থাকবে না। বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ আরো কমে যাবে। দেশ সংকটে পড়বে।
সংকট নিরসনে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আলোচনার কথা একাধিকবার উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “প্রহসনের নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়নি বলে এই সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্বের সরকার নয়। তাই সরকারকে বলছি, আসুন আলোচনার মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে কাজ করি।
“যদি আপনারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হয়ে থাকেন, তাহলে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা নেবেন।”
খালেদার ভাষায় এই সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ ‘অতি ক্ষীণ’।
“তারা মনে করেছে, মামলা-হামলা-গুম করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে। এটা কখনো সফল হবে না। এই সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ অতি ক্ষীণ। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা বিদায় নেবে।’’
বর্তমান সরকারকে ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “ যারা জনগণের ভোটে জয়ী হয়নি, তাদের নিয়ে সংসদ জনপ্রতিনিধির সংসদ নয়। সংসদে জনগণের এমপি নেই। আছে সংসদের আসন। এই সংসদে বিরোধী দলও নেই।’’
দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিন ২৯ জানুয়ারি সারাদেশে বিক্ষোভ ও কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচির কথা তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, “সরকারকে বলব, শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচিতে বাধা দেবেন না।”
বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ সব রাজবন্দির মুক্তিও দাবি করেন তিনি।
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, নির্বাচনে মানুষের সমর্থন না পেয়ে ‘ব্যর্থতা ঢাকতে’ এবং জনগণ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ‘ভিন্নখাতে ফিরিয়ে নিতে’ ক্ষমতাসীনরা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
“হিন্দু ভাইদের বাড়ি-ঘরে হামলা করছে, তাদের ওপর নির্যাতন করছে, বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করছে, দখল করছে।
“সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার দায়দায়িত্ব সরকারের। সরকার ব্যর্থ হয়েছে নিরাপত্তা দিতে, হামলাকারীদের ধরতে।”
সরকার এখন ‘যৌথ অভিযানের নামে’ একের পর এক ‘হত্যা, গুম’ শুরু করেছে বলেও অভিযোগ করেন খালেদা।
সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “বন্ধ করেন, এসব বন্ধ করেন। এর জন্য একদিন জবাব দিতে হবে।”
তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করেন, “যদি মনে করেন, গায়ের জোরে এভাবে ক্ষমতায় থাকবেন, এটা কিন্তু হবে না, হতে দেয়া হবে না।”
জনগণ এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে ‘বিদায় করবে’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
“এই নির্বাচন সবাই প্রত্যাখ্যান করেছে, এ নির্বাচন কারো কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমরা বলতে চাই, অতি দ্রুত আলোচনায় বসে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন।”
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যেখানে ৫ শতাংশ ভোটও পড়ে নাই, সেখানে এই নির্বাচন কমিশন তিন দিন সময় নিয়ে ৪০ শতাংশ ভোট দেখিয়েছে।”
বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে সরকারের ‘আজ্ঞাবহ ও মেরুদণ্ডহীন’ প্রতিষ্ঠান আখ্যায়িত করেন তিনি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছিল অভিযোগ করে বিএনপির নেত্রী দাবি করেন, তার দলের পক্ষেই জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব।
“আওয়ামী লীগ নিজেরাই জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটায়। তাদের সঙ্গে জঙ্গিদের লাইন আছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে দেশ থেকে জঙ্গিবাদও চিরতরে ধ্বংস হবে।’’
খালেদা জিয়া দাবি করেন, বিএনপি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দল। আওয়ামী লীগের নেতারা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি, তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে গেছেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ইউনূসকে সরকার ‘প্রাপ্য সম্মান’ দেয়নি বলেও খালেদার অভিযোগ।
“গ্রামীণ ব্যাংককে শেষ করে দেয়া হয়েছে। নোবেল বিজয়ী এতো বড় সম্মানিত ব্যক্তিকে সরকার অসম্মান ও হয়রানি করেছে।”
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে গ্রামীণ ব্যাংককে ‘আগের জায়গায়’ ফিরিয়ে আনবে এবং ইউনূসকে প্রাপ্য সম্মান দেবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
জনপ্রশাসন, পুলিশসহ সব প্রতিষ্ঠানকে ‘দলীয়করণমুক্ত করে’ ঢেলে সাজানো, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ যুব সমাজের উন্নয়ন নিয়ে দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও খালেদা জিয়া বলেন।
বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করে গত সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা বলেন, “সীমান্তে প্রতিনিয়ত মানুষ হত্যা হচ্ছে। এর কোনো প্রতিবাদ এই সরকার করে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি কাউকে তোয়াক্কা করেন না। তিনি কারো কারো টেলিফোন পেলে দাঁড়িয়ে গিয়ে স্যালুট করেন।
“তবে আমরা জনগণের তোয়াক্কা করি। এটাই আমাদের নীতি।”
মহানগর পুলিশ রোববার সন্ধ্যায় ১২ শর্ত সাপেক্ষে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই জনসভা করার অনুমতি দেয়। দুপুর থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে জড়ো হতে থাকেন নেতাকর্মীরা।
এক পর্যায়ে শাহবাগ থেকে মৎস্যভবন পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
উদ্যানের ভেতরে মঞ্চের সামনে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সাদেক হোসেন খোকা, আমান উল্লাহ আমান, নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম, মীর সরফত আলী সপু, আবদুল কাদের ভুঁইয়া, আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ গ্রেপ্তার নেতাদের মুক্তির দাবি সম্বলিত ডিজিটাল ব্যানার ও ফেস্টুন দেখা যায়।
সমাবেশের কারণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে মোতায়েন করা হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য।
খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মাহবুবুর রহমান, জমির উদ্দিন সরকার, আবদুল মঈন খান, সহসভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, শওকত মাহমুদ, অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মসিউর রহমান, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবীর খোকন, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া, মুন্সিগঞ্জ জেলা সভাপতি আবদুল হাই, গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল বক্তব্য দেন।
১৮ দলীয় জোটসহ অন্যান্য দলের নেতাদের মধ্যে এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত কাজী জাফর আহমদ, এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমেদ, বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বক্তব্য দেন।
এছাড়া এনডিপির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মুর্তজা, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামিক পার্টির সভাপতি আবদুল মোবিন, খেলাফত মজলিশের নায়েবে আমীর মজিবর রহমান, পিপলস লীগের সভাপতি গরীবে নেওয়াজ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশ পরিচালনা করেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক। তাকে সহযোগিতা করেন সহ দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি ও শামীমুর রহমান শামীম।