লংমার্চের মধ্যে রামপালের যাত্রা শুরুর ঘোষণা

সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতায় লংমার্চের মধ্যেই আগামী মাসে এই প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করতে যাচ্ছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Sept 2013, 10:51 AM
Updated : 26 Sept 2013, 10:58 AM

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগামী ২২ অক্টোবর কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিস্থাপন হবে।

বুধবার তার এই ঘোষণার সময় বাম সমর্থিত তেল-গ্যাস সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির লংমার্চ সুন্দরবন অভিমুখে ফরিদপুরে ছিল।

মঙ্গলবার ঢাকা থেকে লংমার্চ শুরু করে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রবিরোধীরা বলছেন, সুন্দরবন লাগোয়া এলাকায় কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সুন্দরবনের প্রতিবেশ ধ্বংস করে দেবে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই বলা হচ্ছে, পরিবেশ দূষণ ও প্রতিবেশ যাতে নষ্ট না হয় সে ব্যাপারে সর্তক থেকেই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ সঙ্কটে থাকা বাংলাদেশ সরকার বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২০১১ সালে সমঝোতা স্মারকের পর ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে।

এই কেন্দ্রের নাম দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, যার সমান অংশীদার থাকছে দুদেশই। 

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিস্থাপনের দিন জানালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা করবেন কি না, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন তৌফিক ইলাহী।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিলের দাবিতে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সুন্দরবন অভিমুখে লংমার্চ। ছবি: তানভীর আহমেদ/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে পরিবেশবিদসহ রামপালের বাসিন্দারাও।

নানা সমালোচনার উত্তর দিতেই মূলত বুধবার বিকালে বিদ্যুৎ ভবনে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়।

লংমার্চ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কার বিষয়ে তৌফিক ইলাহী বলেন, “আবেগ দিয়ে নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এটা বুঝতে হবে। তাদের সমালোচনা তথ্যভিত্তিক নয়, প্রযুক্তিভিত্তিক নয়।

“আমরা ইমোশনের ওপর ভিত্তি না করে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম।

“সারা পৃথিবীতে ৪১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে, ভারতে হয় ৬৮ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে কয়লা থেকে ১ শতাংশেরও কম বিদ্যুৎ হয়।”

বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় দৈনিক উৎপাদন ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

বিদ্যুৎ সচিব বলেন, “এত বিদ্যুৎয়ের জন্য কয়লার কোনো বিকল্প নেই।”

প্রশ্নোত্তরের শুরুতেই এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, দেশে অন্যান্য জায়গা থাকতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালকে কেন বেছে নেওয়া হল?

জবাবে সচিব বলেন, “প্রথমেই আমরা সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখেছি। জনসংখ্যার ঘনত্ব, কয়লা পরিবহন সুবিধা, জমি পাওয়া, স্থানীয়দের পুনর্বাসন সবদিক বিবেচনা করেই রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

“এছাড়া ওই অঞ্চলে (দক্ষিণাঞ্চল) শিল্পের উন্নয়নের বিষয়টিও আমরা বিবেচনায় নিয়েছি।”  

২০৩০ এর মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এরপর আনোয়ারা, মহেশখালীসহ উপকূলবর্তী আরো বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে, বলেন সচিব।

লংমার্চকারীরা বলছেন, ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নিসৃত ধোঁয়া সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করবে। জ্বালানি হিসেবে আনা কয়লা পরিবহনের সময় নদীদূষণ ঘটাবে। বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান নদী দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্য পশুর বিচরণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মনোয়ার বলেন, “সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার এবং বিশ্ব ঐতিহ্য থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।

“সুন্দরবন আমাদের রক্ষাকবচ, সুন্দরবনকে কোনোরকম ক্ষতি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হবে না।”

জীবিকার জন্য সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয়দের জন্য বনের ক্ষতি হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ওই সব মানুষ কাজ পাবে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রামপালের সাপমারী কাটাখালী ও কৈগরদাসকাঠি মৌজায় প্রায় ১৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে তা উন্নয়নের কাজও প্রায় সমাপ্ত হয়েছে।

সচিব বলেন, এই কেন্দ্রের মুনাফার একটি অংশ ব্যয় হবে স্থানীয় মানুষের কল্যাণে।

তৌফিক ইলাহী বলেন, সারা পৃথিবীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তার মূল বিষয় থাকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ।

“রামপালে আমরা কম সালফারযুক্ত উন্নত মানের কয়লা আমদানি করব, যাতে সর্বোচ্চ কম লেভেলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়।“

এ কেন্দ্রের চিমনি প্রায় ২৭৫ মিটার উচুঁতে থাকবে বলে সুন্দরবনের ওপর এর প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করেন তিনি।

কয়লা পরিবহনের জন্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচলের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, আকরাম পয়েন্ট থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা নিয়ে প্রতিদিন একটি জাহাজ মংলা হয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাবে।

“এই জাহাজ পুরো ঢাকা থাকবে। জাহাজ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা নামবে কাভার কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে। তাই এখানে দূষণের কোনো আশঙ্কা নেই।”

আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত এখনো প্রতিদিন জাহাজ চলাচল করছে বলেও  জানান তিনি।