দশম জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে বড় আকারে আসন পুনর্বিন্যাসের দরকার হবে না বলেই মনে করেন একজন নির্বাচন কমিশনার।
Published : 18 Dec 2012, 04:05 AM
দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসন সীমানায় ‘বড়’ কোনো পরিবর্তন আনছে না নির্বাচন কমিশন।
ঢাকা জেলার আসন সংখ্যাও গতবারের মতো ২০টিই থাকছে বলে ইংগিত দিয়েছেন একজন নির্বাচন কমিশনার।
নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকায় আসন বাড়ছেও না, কমছেও না। সারাদেশে বড় আকারে পুনর্বিন্যাসের দরকার পড়বে না। এবার খুবই স্বল্প পরিসরে সীমানা পুননির্ধারণ হবে।”
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে যেসব মতামত এসেছে তার সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করেই কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কমিশনের সংলাপে গিয়ে বর্তমান সীমানা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। সংলাপে না গেলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও কমিশনকে একটি চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে। তারা বলছে, ‘নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি’ নিয়ে ‘জটিলতার’ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আসন সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না বলে তারা মনে করে।
সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে একটি কমিটিও গঠন করেছে বিএনপি। ওই কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ঢাকার আসন কোনোভাবেই বাড়ানো যাবে না। সেই সঙ্গে আগে অযৌক্তিকভাবে অনেক সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করেছে ইসি। এ নিয়ে সব দলের নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। জনগণের সুবিধা বিবেচনা করে আগের কিছু আসন সঠিকভাবে আইন মেনে পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।”
বিএনপির ওই কমিটি দলীয় নেতাদের সমস্যা নিয়ে ‘অভ্যন্তরীণভাবে’ কাজ করেছে উল্লেখ করে সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে দলের পক্ষ থেকে তিনি কোনো বক্তব্য দেবেন না বলে জানান।
বিরোধী দলের আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আসলে বিএনপি ২০০১ সালের নির্বাচনের সময়ের আসন সীমানার পুনর্বহাল চায়। তবে এম কে আনোয়ার বিষয়টি স্বীকার করেননি।
বর্তমানে ঢাকা জেলায় ২০টি সংসদীয় এলাকা আছে, যার মধ্যে ১৫টিই মহানগরীতে । অষ্টম সংসদে এ সংখ্যা ছিল জেলায় ১৩ ও মহানগরীতে আটটি।
ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বের নির্বাচন কমিশন ছোটবড় আকারে ১৩০টি সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস করে। পুনর্বিন্যস্ত সীমানায় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২৩০টি আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট। অষ্টম সংসদে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল।
প্রধান নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সংলাপে জানান, ১৯৭৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ মোটামুটি একই পদ্ধতিতে হয়। ২০০৮ সালে সীমানা নির্ধারণে জনসংখ্যার ঘনত্বকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। এতে ঢাকা মহানগরের সংসদীয় আসনসংখ্যা আট থেকে ১৫-তে উন্নীত হয়। এবারো জনসংখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হলে রাজধানীতে সংসদীয় আসন সংখ্যা হবে ২৫। সেক্ষেত্রে ৩০০ আসনের সংসদে ঢাকার বাইরে আসনসংখ্যা কমে যাবে।
তিনি জানান, সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগের পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব যেমন আসছে, তেমনি বর্তমান সীমানা বহাল রাখার কথাও বলা হচ্ছে। এসব নিয়ে একক ও বহু ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত দরখাস্তও জমা পড়ছে কমিশনে। ঢাকার আসনসংখ্যা ১০-এ কমিয়ে আনার প্রস্তাবও রয়েছে এগুলোর মধ্যে।
সিইসি বলেন, “নির্বাচন কমিশন সবাইকে খুশি করতে পারবে না, আমরা তা চাইও না। আইন মেনেই সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে যিনি অখুশি হবেন তিনিও জানবেন যে, আমরা ন্যায্যভাবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করেছি।”
সীমানা পুনর্নির্ধারণ অধ্যাদেশ-১৯৭৬ অনুযায়ী, সর্বশেষ আদম শুমারির পর পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের জন্য সংসদীয় আসন সীমানা নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, “আঞ্চলিক অখণ্ডতাভিত্তিক প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় রেখে তা করতে গিয়ে যতদূর সম্ভব সর্বশেষ আদমশুমারির প্রতিবেদনের জনসংখ্যার বিভাজন অনুযায়ী সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।”
গত ১৬ জুলাই প্রকাশিত পঞ্চম আদমশুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশে প্রথম আদমশুমারি হয়। ১৯৯১ ও ১৯৯৫ সালে আংশিকভাবে এ কাজ করা হয়। প্রতিবারই সীমানা নির্ধারণ নিয়ে কমিশনকে শত শত মামলার মুখোমুখী হতে হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৮৪ সালের পর প্রথম সারাদেশে একযোগে নির্বাচনী আসন পুনর্বিন্যাসের কাজে হাত দেয় এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ৩০০ আসনের জেলাওয়ারি আসন পুনর্বণ্টন প্রকাশ করে কমিশন।
ওই সময় বিভাগীয় পর্যায়ের আপিল শুনানিতে সারাদেশে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আবেদন জমা পড়ে । এপ্রিলে খসড়া তালিকা প্রকাশের পর জুলাই মাসে চূড়ান্তভাবে পুনর্নির্ধারিত সীমানা প্রকাশ করা হয়।
কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, “আগের ইসির চার মাস লেগেছে আইনি জটিলতা মেটাতে। এই কমিশন তাড়াতাড়ি না করলে এ নিয়ে ঝামেলা বাড়বে। তবে কম সংখ্যক আসন সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হলে ইসি হয়তো সামলাতে পারবে।”
সেপ্টেম্বর-নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাস ধরে সংলাপের পর ‘যত দ্রুত সম্ভব’ সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে খসড়া প্রস্তুত করার কথা রয়েছে বর্তমান কমিশনের। এ সময়ের মধ্যে মহাজোট এবং বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের কয়েকটিসহ মোট ২৮টি দল সংলাপে অংশ নেয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী সংলাপে অংশ নেয়নি। সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বেসরকারি সংস্থাগুলোর অর্ধশতাধিক করে প্রতিনিধি অংশ নেয়।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলাম জানান, কারো ব্যক্তিগত মতকে প্রাধান্য দিচ্ছে না ইসি। অনেক কিছু বিবেচনা করে ঢাকার একটি আসন ও ঢাকার বাইরে কয়েকটি আসনের সীমানায় প্রাথমিকভাবে নজর দেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, উপজেলার অখণ্ডতা ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রধান্য দিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জ, ময়মনসিংহের একটি আসন, কুমিল্লার একটি আসনসহ অন্তত সাত/আটটি আসন পুনর্নির্ধারণ করার কথা বিবেচনা করছে কমিশন।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।