সবার আগে নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম বরণ যাদবের পক্ষে দেশটির রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ গ্রহণ করেন।
Published : 27 Mar 2012, 05:55 AM
একাত্তরে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ৪১ বছর পর সেই বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দিলো বাংলাদেশ।
মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৮৩ জন বিদেশি বন্ধু ও তাদের প্রতিনিধিদের হাতে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ পদক তুলে দেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তারা দুজনেই জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, দেরিতে হলেও একাত্তরের বিদেশি বন্ধুদের অমূল্য অবদানের স্বীকৃতি দিতে পেরে পুরো বাংলাদেশ আজ আনন্দিত।
১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর দমন অভিযানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা। ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেই সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় ঘটে বাঙালির।
মিত্রবাহিনীসহ বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, কূটনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংগঠন সে সময় নানাভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করেন। বিশ্বের কাছে তারা তুলে ধরেন পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার কথা, বাঙালির স্বাধীকারের দাবির কথা।
এই বিদেশি বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই সরকার গত বছর তাদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নেয়। গত বছর সম্মাননা দেওয়া হয় ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে।
এবার সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের জন্য ১৩২ জন বিদেশি নাগরিকের যে তালিকা করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হয় ১১০ জনকে। তাদের মধ্যে ৮৩ জন নিজে এসে অথবা প্রতিনিধি পাঠিয়ে সম্মাননা গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চ সাজানো হয়- লাল-সবুজে, বাংলাদেশের পতাকার রংয়ে। মাঝখানে ছিল জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতি। মঞ্চের দুই পাশে বসেন আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথিরা।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান মঞ্চে ওঠেন সকাল সোয়া ১০টায়। এরপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিদেশি বন্ধুদের ভূমিকা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে শুরু হয় অনুষ্ঠান। বেলা ১১টা ২৫ এ অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছান রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।
তথ্যচিত্র প্রদর্শন শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা সম্মাননা নিতে আসা বিদেশি অতিথিদের পরিচিতি এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের কথা তুলে ধরেন।
এরপর শুরু হয় পদক বিতরণ। অতিথিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় জাতীয় স্মৃতি সৌধের প্রতিকৃতি খচিত সোনায় মোড়ানো রূপার পাতের একটি স্মারক এবং সিল্কের কাপড়ে থাকবে অভিনন্দন বার্তা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এ সময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করেন।
প্রথমে নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম বরণ যাদবের পক্ষে দেশটির রাষ্ট্রদূত ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে। একে একে মোট আটজন সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের প্রতিনিধিরা এই সম্মননা নেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নানাভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহযোগিতা যুগিয়েছে- সেই বন্ধুদের হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ তুলে দেওয়া শুরু হয় এরপর। এ সম্মাননা নেন ৭৫ জন।
শুরুতেই ভারতীয় জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পদক নেন দেশটির হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ। এরপর মুক্তিবাহিনীর পক্ষে এ সম্মাননা গ্রহণ করেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী এম এম পাল্লাম রাজু।
সম্মাননা নেওয়ার পর ভারতের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে স্যালুট দেন। এ সময় দর্শকসারি জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলে তিনিও বলেন- জয় বাংলা।
সম্মাননা প্রদান শেষে অতিথিদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্সের সাবেক সদস্য মাইকেল বার্ন।
সম্মাননা পাওয়া সবার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী, আপনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃত নেতা ছিলেন বলেই জাতির আকাঙ্খা পূরণ করতে পেরেছিলেন।”
বার্নও তার বক্তব্যের পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন।
এরপর বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মণি তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশি বন্ধুদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “এই দিনটি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের বন্ধুদের সম্মানিত করলাম। যারা আমাদের পাশে ছিলো।”
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় চলমান বিচার প্রক্রিয়ায় সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, “আক্রান্তরা বিচার পাওয়ার দাবিদার।”
এরপর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি বিদেশি বন্ধুদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তারা পুরো জাতির পক্ষ থেকে তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান বলেন, “যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মানবিক ও নৈতিক সহায়তা করেছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আজ আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, আমরা জাতি হিসেবে কিছুটা দেরিতে হলেও আপনাদের সেই অমূল্য অবদানের স্বীকৃতি দিতে পারছি। আমি আমার নিজের এবং দেশবাসীর পক্ষ থেকে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল নাম জানা-অজানা বিদেশি বন্ধুর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর শেষ হয় এই সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা।
প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান এবং সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারাও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।