পদ্মা সেতু শুরুতে গাড়ি চলাচলের জন্য খুললেও ট্রেন চলবে না।
Published : 23 Jun 2022, 12:47 AM
তবে এক বছরের মাথায় ট্রেন চলাচলও শুরু করা যাবে বলে আশা করছেন পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন।
আগামী ২৫ জুন এ প্রকল্পের সড়ক অংশ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বহুল প্রতীক্ষিত এ সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী স্বপ্নের এই সেতুর ওপর দিয়ে একই সঙ্গে সড়ক এবং রেলপথ খুলে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও গ্যাস লাইন বসানোর কাজ শেষ করতে না পারায় একই দিনে তা উদ্বোধন করা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে আগামী মাসে ‘পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষকে সেতুর নিচ তলা বুঝিয়ে দেওয়া হলে পরের বছর জুনের মধ্যে রেল চলাচলের উদ্বোধন করা যাবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।
জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আফজাল হোসেন বলেন, “পদ্মা সেতুর ওপর আমরা এখনো কাজ করার সুযোগ পাই নাই। তাই এখনো আমরা পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোতে রেললাইন স্থাপন করতে পারি নাই।
“সেতুর নিচতলা দিয়ে গ্যাস লাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এখনো সেই কাজ শেষ হয়নি। তাই আমরা রেললাইন বসানোর কাজ করতে পারছি না।”
রেল সংযোগ প্রকল্পের এই পরিচালক জানান, পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ (সেতু বিভাগ) আগামী মাসে সেতুর নিচের অংশ তাদের কাছে বুঝিয়ে দেবে বলে জানিয়েছে।
“আমাদের কাছে বুঝিয়ে দিলে আশা করছি ৬ থেকে ৭ মাসের মধ্যে আমরা মূল সেতুতে রেল লাইন স্থাপনের কাজ শেষ করতে পারব।”
ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরপরই আমরা রেল মন্ত্রণালয়কে পদ্মা সেতুর রেলের অংশ বুঝিয়ে দেব। সেতুটি বুঝিয়ে দেওয়ার পর কাজের অগ্রগতির বিষয়টি তাদের হাতে চলে যাবে।”
জানতে চাইলে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, “১৬৯ কিলোমিটার রেল লাইন স্থাপনের এই কাজটি আমরা তিনভাগে শেষ করার পরিকল্পনা করেছি।
“প্রথম পর্যায়ে ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত অংশ শেষ করা। এই অংশটির মাধ্যমেই রেল পদ্মা সেতুতে উঠবে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আমরা এই অংশের কাজটা এগিয়ে রেখেছিলাম।”
যে কারণে ভাঙ্গা থেকে জাজিরা পয়েন্টে সেতুর রেল সংযোগ পর্যন্ত লাইন টেনে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
“কিন্তু সেতুর নিচতলায় গ্যাসের লাইন নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় আমাদেরকে সেতু বুঝিয়ে দিতে পারেনি, আমরাও রেললাইন বসাতে পারিনি। তাই সেতুর সঙ্গে রেল লাইনও উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি।”
আগামী জুনের মধ্যে এই অংশটি শেষ করার আশাবাদ জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, “দ্বিতীয় অংশটি হচ্ছে মাওয়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত। এই অংশটির কাজও আমরা দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছি।
“বড় ধরনের কোনো বাধার মুখোমুখি না হলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই অংশের কাজ শেষ হয়ে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল সার্ভিস চালু হবে।”
এরপর ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত তৃতীয় অংশ। ২০২৪ সাল নাগাদ এই অংশটি শেষ হবে বলে জানান আফজাল হোসেন।
জানতে চাইলে রেল বিভাগের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পদ্মা রেল সংযোগ ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
“পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে রেল সেবা। তাই প্রকল্পটি চালু হলে খুলনার মোংলা বন্দর থেকে খালাস করা পণ্য মাত্র ৪ ঘন্টায় ঢাকায় চলে আসবে।”
তিনি জানান, রেল চালু হলে ওই অঞ্চলে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম চাঙা হয়ে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ শতাংশ বাড়বে বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
পদ্মা রেল যুক্ত হল যেভাবে
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনপদের সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশের সহজ যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্রথম ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পদ্মার ওপর শুধুমাত্র সড়ক তৈরির জন্য প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
ফাইল ছবি
তখন প্রকল্পটি ২০১৫ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং ঠিকাদার ঠিক করতে না পারায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি।
পরে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য বহুজাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মনসেল এইকম’কে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত নকশায় রেল যুক্ত করে দ্বিতল সেতুর নকশা করতে বলা হয়। এরপর ২০১০ সালে নকশা চূড়ান্ত হয়ে যায়।
সংশোধিত নকশায় মূলত সেতুর দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৮৫ থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করা হয়।পাশাপাশি সেতুটি দ্বিতল করা এবং সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে তিনটির নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রাখার পরিবর্তে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখায় খরচ বেড়ে যায়।
সে অনুযায়ী ২০১১ সালের জানুয়ারিতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করা হলে এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
পরবর্তীতে সেতুর নিচতলা দিয়ে রেল চলাচলের জন্য ২০১৬ সালের মার্চে ‘পদ্মা রেল সংযোগ’ প্রকল্প নামে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা।
প্রকল্পটি চীনা ঋণে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু চীনা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে প্রকল্পের ঋণের শর্ত নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকের পর সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ ঋণ দেওয়ার শর্তে ২০১৮ সালে ঋণ চুক্তি হয়।
ঋণ চুক্তিতে দেরি হওয়ায় প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ওই বছরের জুলাই মাস থেকে। দেরি হওয়ার ফলে প্রকল্পের ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায় উন্নীত করে এবং ২ বছর মেয়াদ বাড়িয়ে সংশোধন করতে হয়।
সে হিসাবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ উন্নীত করা হয়। এসময় একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে সড়ক এবং রেল একই দিনে উদ্বোধনের ইচ্ছা পোষণ করেন।
কিন্তু এরপর কাজ শুরু করার পর প্রকল্পটির বাস্তবায়ন আবারও পিছিয়ে পড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে। ২০২০ ও ২১ পরপর দুই বছর চীনা পরামর্শক এবং প্রকৌশলীদের কাজে বিঘ্ন ঘটায় আবারও বাধার মুখে পড়ে প্রকল্পটি।
এমন বাস্তবতায় সড়কের উদ্বোধন হলেও পদ্মার ওপর দিয়ে রেল চলাচল শুরু হতে পারে আগামী বছর জুন নাগাদ।