পদ্মায় ‘বাঁক বদলের সন্ধিক্ষণে’ আমিও ছিলাম: মোশাররফ

সেতু বিভাগের সচিব হিসাবে পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রকল্পের শুরুতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। নকশা থেকে শুরু করে ঠিকাদার নির্বাচন এবং পাইলিং শুরু হয়ে গিয়েছিল তার সময়েই।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 June 2022, 06:34 PM
Updated : 24 June 2022, 09:19 AM

সুপারভিশন কনসালটেন্ট নিয়োগ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক থেকে যখন দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আসে, তার কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল মোশাররফ হোসেনকে। বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির চাপে বাংলাদেশে যে দুর্নীতির মামলা হয়, তার প্রধান আসামি করা হয় তাকে।

সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই কর্মকর্তা, খোয়াতে বসেছিলেন চাকরি। পরিবারকে হতে হয় হেনস্তার শিকার। 

এক পর্যায়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দিকে যায় সরকার; কয়েক বছর পর দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই পান মোশাররফ হোসেনসহ অন্যরা।

পদ্মা সেতু যখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়, তখন অস্থিরতা আর দুর্ভোগের সেই সময়ের কথা বারবার মনে আসছে বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা মোশাররফ হোসেনের।

তার বিবেচনায়, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ’বাঁক বদলের সন্ধিক্ষণ’। আর সেই ইতিহাসে যুক্ত থাকা তার জন্য ’গর্বের’।

পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছিল মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে, সে মামলা পরে বাতিল হয়ে যায়।

এক সাক্ষাৎকারে মোশাররফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করার সিদ্ধান্ত বলতে গেলে বাংলাদেশের টার্নিং পয়েন্ট। এবং, এটার একক কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়।

“কারণ উনি যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি ফেইল করত, পদ্মা সেতু আটকে যেত টাকার অভাবে, তখন নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রকল্প করার সামর্থ্য যে বাংলাদেশের হয়েছে এখন, সেটা ধোপে টিকত না। সারা বিশ্ব যখন দেখল, বাংলাদেশ করেই ফেলছে, তখন এটা খুব সুনাম হল আর কি।”

তবে পদ্মা সেতু এই সফল পরিণতিতে পৌঁছানোর আগে আরও অনেকের সঙ্গে মোশাররফ হোসেনকেও ‘বিনা অপরাধে’ অভিযোগের ভাগী হতে হয়েছে। 

সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার কাছে মনে হইতেছে, আমি যদি এটার সাথে নরমালি চলে যেতাম, মানে বদলি হয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতাম, মানুষ এত মনে রাখত না। ওই টারময়েল আমার উপর দিয়ে যাওয়ায়, আমি যে সেতু বিভাগে কাজ করেছি এবং একটা কঠিন সময় পার করেছি, এটা সবাই স্মরণ করে।”

আরেক প্রশ্নে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, “আমার খুব ভালো লাগছে, এই সেতুর যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসের সাথে আমার নামটাও লেখা আছে বলতে গেলে। আমি কষ্ট ভোগ করেছি, এটার জন্য।”

২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সেতু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পাওয়ার পর ওই বছর ২৯ জুলাই পদোন্নতি পেয়ে সচিব হন মোশাররফ।

তিনি সচিব থাকার সময়ই ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে।

চাকরি ফিরে পাওয়ার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

বিশ্ব ব্যাংকের চাপে দুদক তদন্ত শুরু করলেও সরকার এবং তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন দুর্নীতির অভিযোগ নাকচ করে অনড় থাকেন। এই প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালের জুন মাসে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক।

তখন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯১ কোটি ডলার, তাতে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংকের। বাংলাদেশ সরকার তা নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করেছে মোটামুটি ৩০ হাজার কোটি টাকায়।

বিশ্ব ব্যাংকের সাথে টানাপোড়েন আর দুদকের তদন্তের মধ্যে ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর মোশাররফকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান করে পাঠিয়েছিল সরকার। এক পর্যায়ে ২০১২ সালের ২৪ জুলাই তাকে ওএসডি করে ছুটিতে পাঠানো হয়।

এরপর এসএনসি লাভালিনকে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় সাত জনকে আসামি করে দুদক মামলা করে।

হাই কোর্ট জামিন আবেদন ফিরিয়ে দিলে মামলার ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় দুদক।

গ্রেপ্তারের পর ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি মোশাররফকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। পরের মাস ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ জামিন পেলেও বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার হতে সময় লাগে আরও পাঁচ মাস।

গ্রেপ্তারের সেই সময়ের কথা স্মরণ করে মোশাররফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশকে কীভাবে দায়ী করা যায়, সেই চেষ্টাই করা হল। প্রথম দিকে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছিলেন, মামলা করার মত কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।

”কিন্তু তাদেরকে (বিশ্ব ব্যাংক) সন্তুষ্ট করার জন্য, পরে যেটা বুঝেছি আর কি, তদন্তকারী অফিসাররাও চাপের মুখে ছিল, একটা মামলা তৈরি করছে আমাকে (আসামি করে)।”

দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান পর্যায়ে ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজর ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানও ছিলেন তাদের মধ্যে।

পরে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে যখন মামলা করা হল, তাতে আসামির তালিকায় আরও ছিলেন সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস। 

পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সহমর্মী’ হওয়ায়  ‘ফেরত পেয়েছেন’ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।

মোশাররফ বলেন, মামলায় সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনসহ অন্যদের আসামি না করায় বিশ্ব ব্যাংক ‘অসন্তুষ্ট’ হয়।

“কিন্তু বিশ্ব ব্যাংক বলে নাই যে আসামিদের জেলে নেওয়া হোক। এটা অতি উৎসাহী হয়ে করেছে ওরা (দুদক)। বিশ্ব ব্যাংক হয়ত ভাববে যে সরকার ভালো ব্যবস্থা নিয়েছে, সেজন্য আমাকে অ্যারেস্ট করল, আরও দুজনকে অ্যারেস্ট করল।”

২০১২ সালের ২৬ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করার পর মোশাররফ হোসেনকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে দুদক। পরের বছর ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জজ আদালত তাকে জামিন দেয়। 

সেসব দিনের কথা মনে করে মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমাদের উপর বিরাট অবর্ণনীয় কষ্ট এসে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী সেই সময়েই খুব বিরক্ত হয়েছিলেন যে, তার একজন সচিবকে কেন না জানিয়ে অ্যারেস্ট করা হল। মামলা দিছে ঠিক আছে, মামলা চলুক।

”আমি ৪০ দিনের মতো জেলে ছিলাম। অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট, আমার ফ্যামিলির উপরে একটা মানসম্মান নিয়ে প্রশ্ন আসে। যাই হোক, সেই সময়তো মেনে নিতে হয়েছিল।”

২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তিতে সই করেছিলেন মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। ফাইল ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

মুক্তি পাওয়ার পর ২০১৩ সালের ৫ জুন চাকরি ফিরে পান মোশাররফ হোসেন। তাকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সদস্য করে সরকার।

সেই দায়িত্বের থাকার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ জানিয়ে সব আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় দুদক।

আদালতে পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলা অবসানের দিন ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর শিল্প সচিবের দায়িত্ব পান মোশাররফ। ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল পদোন্নতি দিয়ে তাকে জ্যেষ্ঠ সচিব করা হয়।

২০১৬ সালের ৩০ জুন অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা ছিল মোশাররফের। এর একদিন আগে ২৯ জুন তার পিআরএল বাতিল করে এক বছরের চুক্তিতে তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের দায়িত্বে রেখে দেয় সরকার।

এরপর দুই বছরের চুক্তিতে এনবিআরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন মোশাররফ হোসেন। ২০২০ সালের জুলাই মাসে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে তাকে জার্মানিতে পাঠানো হয়। এখনও তিনি সেই দায়িত্ব পালন করছেন।

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, প্রায় তিন বছর তাকে মন্ত্রণালয়ের বাইরে থাকতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সহমর্মী’ হওয়ায় নষ্ট হয়ে যাওয়া সময় ‘ফেরত পেয়েছেন’ তিনি।

পদ্মা সেতু নিয়ে নিজের লেখা বই হাতে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

”আমার চাকরি যাওয়ার পরও যে সময়গুলি আমার জীবন থেকে নষ্ট হয়েছে, সেগুলি প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসাতে আমার যে কর্মদক্ষতা, সেটা আমি প্রমাণ করতে পেরেছি।

“উনি আমাকে পোস্টিং দিয়েছেন। সিভিল সার্ভিসে যদি কেউ লাইনচ্যুত হয়ে যায়, সে আর উঠে আসতে পারে না। আমি মনে করি, আল্লাহর বিশেষ রহমত আমার উপরে, মানুষের দোয়া- সেই হিসাবে আমি সবটাতে ফিরতে পারলাম।”

পদ্মায় মূল সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধনের সময় উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে মোশাররফ ভূঁইয়া বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন, আমাকে যেন পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয়। আমি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসব।”

নরসিংদীর সন্তান মোশাররফ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়েছেন। সরকারি চাকরিতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮১ সালে।

পদ্মা সেতু ঘিরে ঘটনাপ্রবাহ ও নিজের সম্পৃক্ততার অভিযোগ নিয়ে একটি বইও লিখেছেন মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। বইটির শিরোনাম ‘পদ্মা সেতু: সততা ও আত্ম বিশ্বাসের বিজয়’।