Published : 05 Jun 2022, 11:29 PM
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৭০টির বেশি খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেলা হয়। এর মধ্যে ৩০টি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে, বাকিগুলো দক্ষিণে।
বিভিন্ন ওয়ার্ডে ময়লা অপসারণের দ্বিতীয় ধাপ বা ‘সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন’ (এসটিএস) থাকার পরও ঢাকার উন্মুক্ত সড়কের পাশে এসব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। উত্তরে এ ধরনের সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন রয়েছে ৬০টি, দক্ষিণে ৫২টি।
সিটি করপোরেশনের কর্মীরা কোনো ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে দিনভর খোলা ভাগাড় থেকে ময়লা আলাদা করেন। সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন থেকে যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনেই ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয় বর্জ্য অপসারণ কেন্দ্রে।
বর্জ্য বহনকারী ট্রাকগুলো থেকে আবর্জনা উপচে পড়ে, তরল বর্জ্য চুইয়ে পড়ে সড়কে। ঢাকা শহরের প্রত্যেক জায়গায় এটা খুব সাধারণ দৃশ্য।
পথচারী ও যানবাহনের যাত্রীরা দুর্গন্ধের কারণে হাত বা কাপড় দিয়ে নাক না ঢেকে ওইসব জায়গা পার হতে পারেন না। দুর্গন্ধ এড়াতে তাদের শ্বাসও আটকে রাখতে হয়।
মিরপুরের ৬০ ফুট সড়কের পাশে ময়লার ভাগাড়
মিরপুর-১ এর ৬০ ফুট সড়কে যে ময়লার ভাগাড় তৈরি হয়েছে, তাতে রীতিমত ধাক্কা খেতে হবে যে কাউকে।
যানজট নিরসনে আবাসিক ঘর-বাড়ি উচ্ছেদ করে ২০১৩ সালে এই ৬০ ফুট চওড়া দ্বিমুখী সড়কটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। কিন্তু এই রাস্তার ২০ ফুট এখন ময়লা-আবর্জনার দখলে। রাস্তাটির ফুটপাতও এখন ময়লা ফেলার অস্থায়ী জায়গা হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
দেখা গেছে, এই সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়কে গড়ে উঠেছে তিনটি অস্থায়ী ময়লার ভাগাড়। ওই তিনটি ময়লার স্তূপ লম্বালম্বিভাবে প্রায় ২০০ ফুট জায়গা দখল করে রেখেছে। তপ্ত রোদের মাঝেও ওই তিন জায়গায় মোট ১৭টি ময়লাভর্তি ভ্যান রাখা ছিল।
স্থানীয় দোকানি রেনেসা প্লাস্টিক ডোরের মালিক সোহেল রানা বলেন, “আমি তিন বছরের বেশি সময় ধরে দোকান চালাচ্ছি। আগে লোকজন এখানে আসত, কিন্তু ময়লার কারণে এখন আর আসতে চায় না।
“এই জায়গা একসময় ময়লার ভাগাড় হিসাবে ব্যবহার করা হত, তবে সেসময় শুকনো বর্জ্য ফেলা হত। আর এখন কী ফেলা হয় না সেটা বলেন। এখন মানুষ ও পশুর বর্জ্যসহ সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়।”
সোহেল বলেন, “পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সকালে ময়লা ফেলে যান, বিকালে ট্রাক এসে সেসব নিয়ে যায়। তখন দুর্গন্ধ আরও তীব্র হয়।”
এমন পরিস্থিতির সাথে তুলনা করলে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনের পরিবেশ ‘ভালো’ বলতে হয়। নয়াটোলা, খামারবাড়ি, বাংলামোটরে এসব স্টেশনে দুর্গন্ধের মধ্যেই বিরামহীন কাজ করে চলেছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। যেন ওই ভয়ানক গন্ধও তাদের নাকে পৌঁছাচ্ছে না। তাদের বেশিরভাগকেই দেখা গেছে বর্জ্য থেকে প্লাস্টিক আলাদা করার কাজে ব্যস্ত।
নয়াটোলায় ময়লা অপসারণের ‘সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন’
বর্জ্য অপসারণের প্রাথমিক পর্যায়ে যারা থাকেন, তারা বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে অনুমোদিত সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন বা উন্মুক্ত জায়গায় সেগুলো নিয়ে এসে স্তূপ করেন।
এই প্রাথমিক বর্জ্য সংগ্রহকারীরা সিটি করপোরেশনের কর্মী নন। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করেন এবং যেগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য, সেগুলো আলাদা করেন।
বাছাইয়ের পর সেগুলো ট্রাকে ভরা হয় এবং রাত ১২টার পর মাতুয়াইল এবং আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে নিয়ে ফেলা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বর্তমানে মাতুয়াইল বর্জ্য অপসারণ কেন্দ্র ব্যবহার করছে, যার আয়তন প্রায় ১০০ একর; আর উত্তর সিটি ব্যবহার করছে ৫২ একরের আমিন বাজার বর্জ্য অপসারণ কেন্দ্র।
ঢাকার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে মোটামুটি একইরকম রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় ৮০ শতাংশ বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব, কিন্তু কীভাবে তা করতে হবে, সেই জ্ঞান থাকায় তা আর হচ্ছে না।
তাদের ভাষ্য, আবর্জনা সংগ্রহকারীদের প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে বর্জ্য থেকে শুধুমাত্র প্লাস্টিক আলাদা করে বেআইনিভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে বাজারে বিক্রি করা।
বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরশন থেকে সাড়ে ৭ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন একাই ৩ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য তৈরি করে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ও মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে কঠিন বর্জ্য বাড়তেই থাকবে।
২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে আরবান ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট: অ্যান ওভারভিউ উইথ আ ফোকাস অন ঢাকা’ শিরোনামে একটি সমীক্ষায় গত তিন দশকের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলা হয়েছে, নগর এলাকায় গড়ে ৫৫ শতাংশ কঠিন আবর্জনা সংগ্রহের বাইরেই থেকে যায়।
সমীক্ষায় বলা হয়, ঢাকায় এখন প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর পরিমাণ ২০৩২ সাল নাগাদ বেড়ে সাড়ে ৮ হাজার টন হতে পারে।
ফাইল ছবি
পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি নিয়ে কাজ করা যুব সংগঠন বিডি ক্লিনের প্রতিষ্ঠাতা ফরিদ উদ্দিন বলেন, “আমরা ২০১৬ সাল থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সবথেকে খারাপ।
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “ডিএসসিসি এলাকার আপনি যেখানেই হাত দেবেন, সেখানেই বর্জ্য পাবেন।”
সমাধানের পথ বাতলে তিনি বলেন, মানুষকে ‘কালার কোডেড’ বা বিভিন্ন রঙের বর্জ্য ফেলার পাত্রের সঙ্গে পরিচয় করানো দরকার, যাতে বর্জ্য আলাদা করা সহজ হয়।
তার মতে, পচনশীল, প্লাস্টিক এবং অন্যান্য বর্জ্য রাখার জন্য মানুষ যদি আলাদা রঙের পাত্র ব্যবহার করে, তাহলে বর্জ্য পৃথকীকরণে বিশৃঙ্খলা কমে যাবে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর রওশন মমতাজ বিডি ক্লিনের ফরিদ উদ্দিনের সঙ্গে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করে বলেন, আলাদা রঙের বর্জ্য ফেলার পাত্র অবশ্যই কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, কিন্তু বর্জ্য রিসাইক্লিং এবং কম্পোস্টিং সুবিধা তৈরি না করে কখনোই সফলতা পাওয়া যাবে না।
“ধরুন, বিভিন্ন পাত্রে আমি বর্জ্য আলাদা করলাম, পরিচ্ছন্নতাকর্মী যদি সেগুলো সংগ্রহের পর মিশিয়ে ফেলে, তাহলে কী করবেন? মূলত এটা হতে হবে একটা চেইন লিঙ্কের মত। আমারা যদি লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই, প্রথমে আমাদের প্রযুক্তি এবং আচরণের উন্নতি ঘটাতে হবে।”
অধ্যাপক মমতাজের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বুয়েটের একই বিভাগের অধ্যাপক তানভীর আহমেদ বলেন, “এই শহর গড়ে তোলার আগে আমরা এসব পরিকল্পনা করিনি। আর এখনও এ বিষয়ে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী সঠিক কোনো মাস্টার প্ল্যান নেই।
“কোনো কারণ ছাড়াই এটা সবসময় অবহেলিত থেকেছে। আমরা যা কিছু করি, পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই তা করি। অথবা যখন ঘাড়ে এসে পড়ে, কেবল তখনই করা হয়।”
তিনি বলেন, এখানে তৈরি হওয়া বর্জ্য মূলত তিন ভাগ হয়। একটি অংশ যায় টোকাইদের কাছে, অন্য অংশ বর্জ্য ফেলার জাযগায় ফেলে দেওয়া হয় এবং বাকি অংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়।
“ল্যান্ডফিলে জায়গা না থাকায় সিটি করপোরেশন নিয়মিত বর্জ্য পোড়ায়, আর ঢাকার বায়ু দূষণের এটা অন্যতম কারণ। যদিও সিটি করপোরেশন এই সত্যি কথাটা স্বীকার করবে না।”
বুয়েটের এ দুই অধ্যাপকই মনে করেন, মাটিতে বর্জ্য পুঁতে ফেলা কোনো সমাধান হতে পারে না, কারণ বাংলাদেশে সেজন্য পর্যাপ্ত জমি নেই।
তারা বলছেন, যেসব বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য, সেগুলো রিসাইক্লিংয়ের অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। আর পচনশীল বর্জ্য পচিয়ে মিশ্র সারের প্ল্যান্ট তৈরি করতে হবে। যদি আবর্জনা ঠিকভাবে বাছাই করে সরবরাহ করা যায়, তাহলে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে নিয়ে এসে সেগুলি বাছাবাছি করার দরকার পড়বে না।
দুটি ট্রাকের একটি কম্পোস্টিং প্ল্যান্টে যাবে, যেখানে বর্জ্যকে জৈব সারে রূপান্তরিত করা হবে। অন্যটি যাবে বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার প্ল্যান্টে।
আর যেগুলো পুনর্ব্যবহার করা যাবে না, শুধুমাত্র সেগুলোই ল্যান্ডফিলে নেওয়া হবে এবং ইনসিনারেটরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে, যাতে দূষণ সৃষ্টিকারী সমস্ত কণা ধ্বংস হয়।
তাদের ভাষায়, বর্তমানে যেভাবে ল্যাণ্ডফিলে বর্জ্য নিয়ে জমা করা হয়, তা পুরোপুরি অকার্যকর। কম্প্যাক্টর ব্যবহার করে প্রথমে বর্জ্যের পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে হবে। তারপর আবর্জনার স্তূপের ওপর নিয়মিতভাবে মাটির স্তর দিতে হবে। সেই বর্জ্য প্রাকৃতিকভাবে ধীরে ধীরে পচে যাবে।
তবে এই প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি, সেজন্য ৫০ বছরের বেশি সময় লেগে যাবে।
ফাইল ছবি
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এস এম শরীফ-উল ইসলাম বলেন, একটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন তৈরির জন্য চার থেকে পাঁচ কাঠা (১ কাঠা সমান ৭২০ বর্গফুট) জমি প্রয়োজন, কিন্তু মানুষ সাধারণত তাদের বাড়ির সামনে এই অবকাঠামো তৈরি করতে দিতে চায় না।
“একটি দুর্ঘটনার পর আমরা দিনের বেলায় বর্জ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছি। এর ফলে যানবাহন ও জনবলের অভাবে সকালের আগেই বর্জ্য সংগ্রহ করে সেগুলো ভাগাড়ে নিয়ে ফেলা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।”
এদিকে চুরি ঠেকাতে উত্তর সিটি সিসিটিভি ক্যামেরাসহ আবর্জনা ফেলার আধুনিক পাত্র কেনার পরিকল্পনা করছে বলে জানান তিনি।
তার ভাষ্য, আমিন বাজারের ভাগাড়টি মাটি থেকে ৮০ ফুট উঁচু হয়ে গেছে এবং এখনই ব্যবস্থা নেওয়ার সময়।
“তবে চীনের সাথে আমাদের বহু প্রতীক্ষিত সেই প্রজেক্টের কাজ শুরু করে দিয়েছি ইতোমধ্যে। আমরা চীনা মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন-সিএমইসিকে প্রতিদিন ৩ হাজার মেট্রিক টন মিশ্র বর্জ্য সরবরাহ করব, যা দিয়ে ওরা দৈনিক ২৪ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। আর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ওদের থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে ১৮ দশমিক ২৯ টাকায়।”
সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যে আমিনবাজার ল্যান্ডফিলের ৩০ একর জমি সিএমইসিকে হস্তান্তর করেছে। তারা উত্তর সিটিকে বার্ষিক ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ভাড়া দেবে। বিপিডিবিও এ প্রকল্পের অংশীদার।
এদিকে, দক্ষিণ সিটির মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের অবস্থাও শোচনীয়। সেখানেও এখন আবর্জনার দুটো পর্বত তৈরি হয়েছে। এর একটি ৭০ ফুট, অন্যটি ৬০ ফুট উঁচু হয়ে উঠেছে।
এ সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর সিতওয়াত নাঈম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইতোমধ্যে তারা ময়লা রাখার জন্য ২০টি ওয়ার্ডে আধুনিক কনটেইনার বক্স স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন। এ অর্থবছরে আরও ছয়টি ওয়ার্ডে সেই বক্স দেওয়া হবে।
“আমাদের ক্লিন ঢাকা মাস্টারপ্ল্যান (২০১৮-২০৩২) ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ প্রকল্প যদি ঠিকঠাক এগোয়, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা বর্জ্য থেকে জৈব সার, বায়ো গ্যাস ও বিদ্যুৎ তৈরির দিকে যাব।”