রাজধানীর মিরপুরের কালশী থেকে মহাখালীর আমতলী যেতে মঙ্গলবার চারটায় বাসে উঠেছেন ফাহমিদা ইসলাম। বনানীর জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার হয়ে ১০ কিলোমিটারের এ পথ আসতে অন্য সময় সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা লাগলেও এদিন লেগেছে দুই ঘণ্টার বেশি।
Published : 05 Apr 2022, 11:01 PM
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ফাহমিদার যাত্রাপথে তখন অফিস ফেরত গাড়ির দীর্ঘ বহর বিমানবন্দর সড়কের মহাখালী থেকে বনানী হয়ে ওই ফ্লাইওভার ছাড়িয়ে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত চলে গেছে। কালশী থেকে মাটিকাটা, ইসিবি চত্বর হয়ে বনানীগামী যানবাহনও আটকে যায় যানজটে, গাড়ি যেন নড়েই না। ফলে মঙ্গলবার এ পথটুকু আসতে চারগুণ বেশি সময় লাগে তার।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার কিছু আগে ফাহমিদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোমবারও এ পথে প্রচণ্ড যানজট ছিল।
“আজও একই অবস্থা। ফ্লাইওভারের ওপরে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বসা। গাড়ি চলেই না যেন। কেন এত জ্যাম বুঝতেছি না।”
মার্চের মাঝামাঝিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর থেকে ঢাকায় প্রতিদিনই প্রচণ্ড যানজটে ভোগান্তি পোহাচ্ছে মানুষ। রোজা শুরুর পর যানজট আরও তীব্র হয়েছে। বিশেষ করে সকালে কর্মস্থলে যাওয়া এবং ইফতারের আগে বাসায় ফেরার পথে যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে দীর্ঘক্ষণ।
হঠাৎ রোজার শুরুতে যানজট আরও তীব্র হওয়ার নানান কারণের মধ্যে রমজানে অফিস সময় পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে এসেছে বেশি। এছাড়া সড়কে যত্রতত্র পার্কিং, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মত পুরনো কারণের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর স্কুল চালু হওয়ার বিষয়টিও রয়েছে বলে জানাচ্ছেন চালক, যাত্রী ও ট্রাফিক সংশ্লিষ্টরা।
গত দুদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই রাস্তায় ইফতার করার ছবি পোস্ট করেছেন। যানজটের ভোগান্তি নিয়ে নানান মন্তব্য করেছেন। রোজার শুরুতেই হঠাৎ সড়কে নাস্তানাবুদ হয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
“অন্য সময় অফিস ছুটি হলেও ঘরে ফেরার এত তাড়া থাকে না। রোজায় যেটা রয়েছে। ফলে কম সময়ে অনেক যানবাহন যাচ্ছে, আসছে। ফলে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও পুলিশ যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।”
রমজানের তৃতীয় দিন মঙ্গলবার সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন সড়কে তৈরি হয়েছে তীব্র যানজট। সকালে শুরু হওয়া যানজট পরিস্থিতি বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা কমে। তবে দুপুরের পর তা আরও তীব্র হয়।
মহাখালীর তিতুমীর কলেজ থেকে মোহাম্মদপুরের বাসায় যেতে মঙ্গলবার বেলা ৫টায় অটোরিকশায় উঠেছেন মিনহাজুল আবেদীন। বেশ কিছু সময় তাকে বহনকারী যানটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
মিনহাজুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোজার শুরু থেকেই যানজট তীব্র হয়েছে। সন্ধ্যার আগে বাসায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এজন্য কিছু হালকা ইফতার, পানি কিনে নিয়েছেন তিনি।
“যে জ্যাম দেখছি, ইফতার রাস্তায় করতে হবে। সেজন্য একটা পানি বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট কিনে নিলাম। বাসায় না পৌঁছাতে পারলে সিএনজিতেই ইফতারি সারব।”
মঙ্গলবার সকাল থেকে রামপুরা, মালিবাগ, মগবাজার, শান্তিনগর এলাকায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
সকাল ৯টায় বনশ্রী থেকে রমজান পরিবহনের একটি বাসে উঠেন ময়মনসিংহ থেকে আসা আফজাল হোসেনসহ তিনজন। সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের মালিবাগ রেলগেইটে আসতে সময় লাগে এক ঘণ্টা।
অথচ শান্তিনগরে এক আইনজীবীর অফিসে যেতে এক ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বনশ্রীর আত্মীয়ের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুরো পথ যানজটে আটকে থেকে মালিবাগ রেলগেইটে আসতেই এক ঘণ্টা পার; সেখানে এসে যেন বাস আর চলছেই না।
রামপুরা এলাকায় একটি ব্যক্তিগত গাড়ির চালক হামিদুল্লাহ বলেন, সকালে গুলশান থেকে শান্তিনগর এসেছিলেন পৌনে এক ঘণ্টায়। বেলা সাড়ে ১২টায় শান্তিনগর থেকে রওনা হয়ে দুপুর দেড়টায় রামপুরা ব্রিজের কাছে পৌঁছুতে পেরেছেন মাত্র।
তার ভাষ্য, সড়কের পাশে গাড়ি পার্কিং এবং ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ার কারণে এ রকম যানজট হচ্ছে।
শান্তিনগর, বিজয়নগর, কাকরাইল ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন অলিগলিতে রিকশা, ঠেলাগাড়ি রাখা হয়েছে। দুটো গাড়ি আসা যাওয়া করতে পারে এমন সড়কে এভাবে যানবাহন রেখে দেওয়ায় তৈরি হচ্ছে যানজট।
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রেহুনুমা আহমেদ বলেন, “মেয়েকে নিয়ে মালিবাগের বাসায় যাব। এক ঘণ্টা ধরে বসে আছি, রিকশা চলছে না। সকালে মেয়েকে নিয়ে যখন আসি তখন যানজট ছিল না। দুপুরের পরে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে প্রাইভেট কারগুলো।”
কাকরাইল, সেগুনবাগিচা, সচিবালয় এলাকায় বিভিন্ন সরকারি অফিসের বাইরের সড়কে গাড়ি রাখায় যানজট তৈরি হয়েছে।
একইভাবে সড়কে গাড়ি রাখায় মঙ্গলবার দুপুরে মহাখালী টার্মিনালের সামনের রাস্তাতেও গাড়ির জট দীর্ঘ হয়েছে। এ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, দূরপাল্লার বাস রাখা হয়েছে রাস্তায়, বাস থামিয়ে তোলা হচ্ছে যাত্রী। ফলে পেছনের বাসগুলো থেমে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে যানজট।
কিশোরগঞ্জ রুটের উজানভাটি পরিবহনের একটি বাস থামিয়ে চালক ভেতরে ঘুমাচ্ছিলেন। ওই বাসের আগে-পরে আরও কয়েকটি বাস রাখা। জানতে চাইলে ওই বাসের চালক মোবারক হোসেন বলেন, “টার্মিনালে রাখার জায়গা নাই। এজন্য এইখানে রাখি। তবে বেশিক্ষণ থাকি না।”
জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের সহকারী উপ পরিদর্শক আবদুল আজিজ বলেন, “এখানে গাড়ি রাখায় গাড়ির গতি কিছুটা কমে যায়। কিছুটা যানজট হয়। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।”
মহাখালী থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত ১০টি সিএনজি ফিলিং স্টেশন। গত কয়েকদিন ধরে বিকাল ৫টা থেকে ১১টা পর্যন্ত গ্যাস দেওয়া বন্ধ থাকায় চালকরা আগেই এসে গ্যাস নিতে ভিড় করছেন। প্রতিটি ফিলিং স্টেশনের সামনেই গ্যাস নিতে আসা যানবাহনের সারি চলে গেছে সড়কে। দুপুর ২টায় মহাখালীর সিএনজি স্টেশনগুলোতে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।
গ্যাস ভরতে আসা যানবাহনের কারণেও যানজট প্রকট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ট্রাফিকের উপপরিদর্শক সাজ্জাদ হোসেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এসব কারণে এই এলাকায় যানজট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা রেকারিং করতে যাই, চালকরা অনুরোধ করে, বলে গাড়িতে গ্যাস নাই।”
মঙ্গলবার খিলগাঁওয়ে যানজট অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা কম ছিল। খিলগাঁও রেলগেট এলাকার ফল ব্যবসায়ী হারুন আল কাউসার বেলা ১২টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে অফিস টাইমে কিছুক্ষণ জ্যাম ছিল। এরপর থেকে রাস্তা ফাঁকাই আছে। সিগন্যাল বাদে গাড়ি ঘোড়ার তেমন জটলা নেই।”
রাজারবাগ থেকে পুরানা পল্টন যাওয়ার সিগন্যালেও আগের দুদিনের চেয়ে যানবাহনের চাপ কিছুটা কম দেখা গেছে।
রাজারবাগ মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল খুরশিদ আলী বলেন, “দুপুর পর্যন্ত তো জ্যাম তেমন ছিল না। বিকালে অফিস ছুটির সময়ে হয়ত যানজট বাড়তে পারে।”
মঙ্গলবার সকালে মিরপুর থেকে বিজয় সরণি হয়ে ফার্মগেইট পর্যন্ত সড়কে কিছুটা যানজট দেখা গেছে। বেসরকারি চাকুরিজীবী ইকরাম উদ্দিন জানান, সাড়ে ৮টায় মিরপুর ১১ নম্বর থেকে ফার্মগেইট পর্যন্ত যেতে ফারহানা ইসলামের সময় লেগেছে ১ ঘন্টা ১০ মিনিট।
ইকরাম বলেন, “রাস্তা ফাঁকা থাকলে আধা ঘণ্টায় ফার্মগেইট যেতে পারি। তবে বিজয়সরণিতে প্রায় ২০ মিনিট জ্যামে থাকতে হয়েছে। এজন্যই একটু বেশি সময় লেগেছে।”
মেট্রো রেলের নির্মাণকাজের জন্য রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও যেতে বরাবরই যানজট পোহাতে হয় যাত্রীদের। বেসরকারি চাকরিজীবী রফিকুল ইসলাম জানান, সোমবার সকালে ও বিকালে প্রচুর যানজটে পড়তে হয়েছে তাকে।
“আজকে (মঙ্গলবার) গুগল ম্যাপ দেখে দুপুরে বের হয়েছি, যানজট এড়াতে। কালশী থেকে ১২টা ৫০ এ রওনা দিয়ে দুপুর দেড়টায় নাবিস্কোতে এসেছি। বনানী থেকে মহাখালী পর্যন্ত টুকটাক সিগন্যালে পড়েছি। জ্যাম ছিল না। সাধারণ সময়ে একই চিত্র থাকে এই রাস্তায়।”
নিউ মার্কেট মোড়ে দায়িত্বরত পুলিশ সার্জেন্ট আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত তিন দিনের চেয়ে মঙ্গলবার দুপুরে যানবাহনের চাপ কিছুটা কম।
“রোজার আগে যে তীব্র যানজট দেখা যেত সেরকম হয়নি। বিকালের দিকে চাপ বাড়ে; তবে সেই চাপ তীব্র নয়।”
তবে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর, ২৭ নম্বর, শুক্রাবাদ ও সোবহানবাগ এলাকায় সড়কে তীব্র যানজট দেখা গেছে।
বিকাশ পরিবহনের যাত্রী দেলোয়ার হোসেন বলেন, নিউমার্কেট থেকে ১০ মিনিটেই ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে চলে এসেছেন। তবে এরপরই যানজট শুরু হয়েছে।
“সোবহানবাগ, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর পার হতেই ৪০ মিনিট সময় লেগে গেছে। বিজয় সরণিতেও যানজটে পড়তে হয়েছে। বেলা সোয়া ১২টায় নিউ মার্কেট থেকে বাসে উঠে মহাখালী পৌঁছেছি পৌনে ২টায়।”