ভোরের ঢাকায় ছুরিকাঘাতে দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুলকে হত্যার জন্য পুলিশ ছিনতাইকারীদের দায়ী করলেও তার পরিবারের ধারণা ভিন্ন।
Published : 27 Mar 2022, 09:06 PM
বুলবুলের সঙ্গে থাকা ১২ হাজার টাকা এবং মোবাইল ফোন দুটোর কোনোটিই খোয়া যায়নি বলে অন্য সন্দেহ করছেন তার শ্বশুর ইয়াকুব আলী।
“যদি টাকা আর মোবাইল দুইটাই সাথে থাকে, তাহলে এটা কীভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনা হয়?” বলেন তিনি।
রোববার বিকালে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে বুলবুলের লাশের জন্য অপেক্ষায় থাকার সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একথা বলেন ইয়াকুব।
এদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে শেওড়াপাড়ায় মেট্রোরেলের ২৭৮ নম্বর পিলারের কাছে ছুরিকাহত হন বুলবুল। তিনি ব্যাটারিচালিত একটি রিকশায় ছিলেন।
৩৮ বছর বয়সী বুলবুল দন্ত চিকিৎসক হিসেবে মগবাজারে ‘রংপুর ডেন্টাল’ নামের একটি চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখতেন। পাশাপাশি গত পাঁচ বছর ধরে ‘মেসার্স রংপুর ট্রেডার্স’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি৷
বিএনপি ঘরানার চিকিৎসক বুলবুল ‘পথশিশু সেবা সংগঠন’সহ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনেও যুক্ত ছিলেন।
ঠিকাদারি কাজে নোয়াখালী যাওয়ার জন্য ভোরে বুলবুল বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন বলে জানান তার শ্বশুর ইয়াকুব।
ওই সময় তিনি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন বলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাহতাব উদ্দীন দাবি করছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যতদূর জানি, তিনজন ছিনতাইকারী ছিল। এরা এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে।”
হত্যাকাণ্ডস্থলের আশপাশের এলাকার সিসি ক্যামেরার ভিডিও সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তার ভিত্তিতে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তিনজন ছিনতাইকারী ঘটনার পর দুটো দলে ভাগ হয়ে হেঁটে গলির পথ ধরে চলে যায়।
ডিসি মাহতাব বলেন, “তিনি একটা অটোরিকশায় ছিলেন। যাওয়ার পথে ওখানে ওয়ানওয়ে টাইপের। ওখানে তাকে ধরেছে। মেট্রোরেলের কাজের কারণে ১০ নম্বর থেকে শ্যাওড়াপাড়া পর্যন্ত গাড়ি চলে খুব ধীরে। যার কারণে অপরাধীরা সুযোগ পাচ্ছে।”
‘ছিনতাইকারীরা’ বুলবুলের বুক পকেট থেকে একটি মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে বলে পুলিশ কর্মকর্তা মাহতাব দাবি করলেও তার শ্বশুর ইয়াকুব বলছেন, তার জামাতা একটি ফোনই ব্যবহার করতেন।
মাহতাব বলেন, “তার ডান পায়ের উরুতে স্ট্যাব করে তার বুক পকেটে থাকা একটি মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। আরেকটা মোবাইল ও মানিব্যাগ তার যে পকেটে ছিল সেটা তারা নিতে পারেনি।”
তবে বুলবুলের কাছে একটি মোবাইল ছিল দাবি করে ইয়াকুব বলেন, “তার কাছে থাকা মোবাইল ফোন থেকে নম্বর নিয়ে পুলিশ প্রথমে বুলবুলের মাকে ফোন দেয়। এরপর বুলবুলের মা আমাকে ফোনে বিস্তারিত জানায়।”
ভিন্ন সন্দেহ করলেও কী কারণে বুলবুলকে কেউ খুন করতে চাইবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারেনি তার পরিবারের কেউ।
ছিনতাই ভিন্ন অন্য কিছু হতে পারে কি না- এই প্রশ্নে পুলিশ কর্মকর্তা মাহতাব বলেন, “হতে পারে এটা ছিনতাই নয়। অন্য কোনও ঘটনা হতে পারে। যেটাই হোক, আমরা সেগুলো উদঘাটনের চেষ্টা করছি।”
বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী আক্তার বাদী হয়ে রোববার অজ্ঞাতনামা ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেছেন বলে জানান মিরপুর থানার ওসি মোস্তাজিরুল ইসলাম।
চিকিৎসকও হলেও পাননি চিকিৎসা
ছুরিকাহত বুলবুলকে কাছের আল হেলাল হাসপাতালে নিয়েছিল পথচারীরা। কিন্তু সেখানে তাকে কোনো চিকিৎসা না দিয়েই ফিরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য, এই চিকিৎসকের ডান পায়ের উরুতে একটি আঘাতই করা হয়েছিল। উরুর সেই জখম থেকে অনেক রক্ত পড়ছিল।
পুলিশ কর্মকর্তা মাহতাব বলেন, “প্রত্যক্ষদর্শীদের যে বর্ণনা, সেটা হচ্ছে তিনি চিৎকার করার কারণে ছিনতাইকারীরা চলে যায়। তিনি যখন দেখেন রক্ত পড়ছে, তখন স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাকে আল হেলাল হাসপাতালে নেওয়া হয়।
“আল হেলাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার চিকিৎসা করতে না পেরে তাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যাওয়ারও অনেকক্ষণ পরে তিনি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়েন।”
বুলবুলের উরুতে ছুরির একটাই জখম ছিল এবং তা তেমন গুরুতর মনে হয়নি পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে।
তাহলে মৃত্যুর কারণ কী হতে পারে- প্রশ্ন করলে মাহতাব বলেন, “এটা বলবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ডান পায়ের উরুতে আঘাতের ফলে একটা লোক মারা গেল, এটা আপনাদের মতো আমার কাছেও রহস্য। এটা রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যু, না অন্য কারণে, তা ময়নাতদন্ত রিপোর্টেই উঠে আসবে।”
দিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, মেট্রোরেলের নির্মাণযজ্ঞে চারদিক ধুলোয় ধূসর। এর মধ্যে এক কোণায় রক্তে কালচে হয়ে রয়েছে অনেকটা মাটি।
মো. ইসমাঈল নামে স্থানীয় এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, এখানেই ঘটেছে ঘটনা। এরপর শ দুয়েক গজ দূরের আল হেলাল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল বুলবুলকে। কিন্তু ওই হাসপাতালে কোনো চিকিৎসা হয়নি।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গে বুলবুলের ময়নাতদন্ত হয়। সেখানে তার অনেক বন্ধু ও স্বজনরা এসেছিলেন। তারাও চিকিৎসা না পাওয়ার কথা বলছিলেন।
‘পথশিশু সেবা সংগঠন’ স্বেচ্ছাসেবক সাখাওয়াত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বুলবুলের উরুতে যেই জখমের চিহ্ন আছে, এতটুকু জখমে কেউ মারা যেতে পারে? সেটা খুবই রহস্যজনক।”
বুলবুলের বন্ধু মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, “প্রথমে সেই (আল হেলাল) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তারা পুলিশ কেস বুঝতে পেরে বুলবুলকে হাসপাতালেই ঢুকতে দেয়নি। তারা চিকিৎসা না দিয়ে ৯৯৯ এ কল দিয়ে পুলিশকে খবর দেয়। এখানেও কিছু সময়ক্ষেপণ হয়েছে, যার কারণে অতিরিক্ত রক্তপাতেই তিনি মারা গেছেন।”
পুলিশি ঝামেলা এড়াতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে হামলায় জখম ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ বহু পুরনো।
দুপুরে আল হেলাল হাসপাতালে গিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি এই হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক পলাশ কান্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আহত বুলবুলকে তার হাসপাতালে ঢোকানোই হয়নি।
হাসপাতালে কি জরুরি বিভাগ ছিল না, কেন ঢোকানো হল না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা ডিউটি ডাক্তার বলতে পারবেন। আপনি এখন যে ডিউটি ডাক্তার, তার সঙ্গে কথা বলেন। আগের ডিউটি ডাক্তার তাকে দায়িত্ব হস্তান্তর করে গেছেন।”
হাসপাতালের দুপুরে কর্মরত চিকিৎসক জিয়া দাবি করেন, বুলবলুকে হাসপাতালে আনাই হয়নি।