চাপে নত হবে না, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সার্চ কমিটিকে।
Published : 13 Feb 2022, 10:38 PM
রাষ্ট্রপতি গঠিত এই কমিটির বিশিষ্টজনদের বৈঠকে রোববার এমন পরামর্শ আসে। শনিবার শুরু করে তিন দফায় বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠক করে সার্চ কমিটি।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল
বৈঠক থেকে বেরিয়ে লেখক অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা বলেছি, আপনারা এমন লোক বাছাই করুন, যারা নিজের বিবেকের কাছে ঠিক থাকবেন।
“তারা সাহসী থাকবেন, তারা কোনো ভয় পাবেন না। দলীয় চাপের মুখে নতি স্বীকার করবেন না, সেই ধরনের লোকই আমরা চাই।”
অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, “যিনি সৎ এবং সাহস করে কাজ করতে পারেন, এমন লোকের নাম প্রস্তাব করার জন্য বলেছি।”
পিকেএসএফের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে, তারা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কাজ করবেন। সৎ, সাহসী ও দুর্নীতিমুক্ত হবেন এবং সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা অথাৎ তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে হবে। তারা যেন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হোন। এসব ব্যাপারে কোনো আপস নেই।”
শাহরিয়ার কবির
লেখক শাহরিয়ার কবির বলেন, “সেই ব্যক্তিদের আমরা দেখতে চাই, যার মেরুদণ্ড আছে, সাহস আছে। প্রধানমন্ত্রীও যদি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, তাহলে তাকেও জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে, এই সাহসী ব্যক্তিদের আমরা নির্বাচন কমিশনে দেখতে চাই।”
কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন সোমবারই তাদের মেয়াদি শেষ করছে। তাদের উত্তরসূরি হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে নামের প্রস্তাব দেওয়ার দায়িত্ব এই সার্চ কমিটির। সার্চ কমিটির প্রস্তাব থেকে একজন সিইসি এবং অনধিক চারজন কমিশনার নিয়ে নতুন ইসি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি।
সার্চ কমিটি ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও নামের প্রস্তাব নিয়েছে। তার পাশাপাশি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করছে। সার্চ কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্টের জাজেজ কনফারেন্স কক্ষে এই বৈঠক হয়।
জাফর ইকবাল বলেন, “আমাদের সবার প্রস্তাব একটাই, আমাদের এমন একটা দেশ তৈরি হবে সে দেশে যারাই রাজনীতি করবে, তাদেরকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হতে হবে। যতদিন সেটা না হচ্ছে, ততদিন আমরা বুঝব, আমাদের দেশে রাজনীতি সঠিকভাবে হচ্ছে না।”
সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এ দেশে এখনও স্বাধীনতাবিরোধী লোক আছে। তারা কি একজন স্বাধীনতার পক্ষের কোনো মানুষকে গ্রহণ করবে?
“কাজে সর্বজনগ্রহণযোগ্য কথাটা একটু জটিল। আমরা সার্চ কমিটিকে বলেছি, আপনারা ভয় পাবেন না। আপনারা বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকেন। কে কী বলছে, সেটা নিয়ে আপনারা মাথা ঘামাবেন না।”
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, “আমি বলবো আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসি চেয়েছি। যেখানে প্রচলিত ধারা আমলাতন্ত্র, বিচারবিভাগের বাহিরে গিয়ে সুশীল সমাজের জোর দিতে হবে। নারী এবং সংখ্যালঘুর উপর জোর দিতে হবে।”
শনিবারের বৈঠকে বিশিষ্টজনদের অনেকেই নতুন ইসি নিয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাভাজন’ ব্যক্তির প্রত্যাশা করলেও এর উল্টো কথা বলেন মুনতাসির মামুন।
তার ভাষ্য, “বাংলাদেশে কখনও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। তার মতো ব্যক্তি গ্রহণযোগ্য না হন, এখানে আমরা এসব কথা বলি এটা ‘কল্পনার রাজ্য’ হয়ে যাবে।”
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, “যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে তাদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হতে হবে। এ জন্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা কী ছিল, তিনি কোথায় ছিলেন এবং ৭৫ পরবর্তী ভূমিকাগুলো খতিয়ে দেখতে হবে।
“এর সঙ্গে এটাও বলেছি, যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে তারা যেন সৎ, সাহসী হোন এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচন উপহার দিতে পারেন। আর কমিশনে যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় সেই প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।”
শাহরিয়ার কবিরও বলেন, “যিনি নির্বাচিত হবেন, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের হতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে, আমাদের সংবিধানে বিশ্বাস করতে হবে।”
তবে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজতে নতুন ইসির জন্য সার্চ কমিটির যে সময়সীমা আইনে রয়েছে, সেই ১৫ দিন যথেষ্ট নয় বলে মত দেন তিনি।
সার্চ কমিটিতে আসা প্রস্তাবকসহ নাম প্রকাশের দাবি সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার জানালেও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বিপরীত মত দেন।
বদিউল আলম মজুমদার।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমার কতগুলো প্রশ্ন আছে, কতগুলো উদ্বেগ আছে, কতগুলো পরামর্শ আছে। পরামর্শে আমি বলেছি, নামগুলো প্রকাশ করতে হবে তিনবার। যে নামগুলো এসেছে, কোন দল কার নাম প্রস্তাব করেছে, এগুলো প্রকাশ করতে হবে।”
এই নাম থেকে বাছাইয়ের মানদণ্ড কী, তাও প্রকাশের আহ্বান জানান তিনি।
“আমরা জানতে চাই, কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে এবং কী মানদণ্ড অনুসরণ করবে। জাতি একটা সঙ্কটের মধ্যে আছে, আমরা সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য এটা জানা দরকার। যাতে আস্থার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারি।”
রাজনৈতিক দল থেকে প্রস্তাব করা নামগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, “যদি স্বাধীন নির্বাচনের কথা বলেন, তাহলে দলের প্রস্তাব নিতে আমার আপত্তি আছে। কোনো দলের প্রস্তাব আমি নিতে চাই না।
“আমাদের সংবিধানে বলা আছে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এখানে বলা নাই দলীয়ভিত্তিক নির্বাচন কমিশন। বিশ্বে তিন-চার রকমের নির্বাচন কমিশন আছে। দলীয়ভিত্তিক আছে, সরকারি নির্বাচন কমিশন আছে, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন আছে।”
এম সাখাওয়াত হোসেন
সাখাওয়াত বলেন, “আমি কোনো প্রস্তাব দিইনি। আমি কতগুলো মত দিয়েছি। মতটি হল, সার্চ কমিটি করুন, চারশ বা পাঁচশ লোক বের করুন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। মানুষের কোনো বিশ্বাস নেই। এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে যে লোকগুলোর প্রয়োজন তাদেরকে সার্চ করুন। যার দ্বারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে সেই সাহস তারা রাখেন, সেই ধরনের লোক খুঁজে বের করুন।”
আগামী নির্বাচন নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আগামী নির্বাচন হতে হবে সর্বজন গ্রহণযোগ্য। আমি বলছি না শতভাগ গ্রহণযোগ্য হতে হবে। শতভাগ গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন হয় না। নির্বাচন হতে হবে- যারা ভোট দিচ্ছে, ভোট দিতে পারছে বা ভোট দিতে পারবে, তাদের মতামত যাতে প্রতিফলিত ঘটে।”
তৃতীয় বৈঠকে ড. আইনুন নিশাত, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ আলী জহির, প্রজন্ম একাত্তরের আসিফ মুনির তন্ময় ও নুজহাত চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি নুরুল আলম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের গোলাম কুদ্দুস, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, গীতিকার ও সুরকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, অধ্যাপক উবায়দুল কবির চৌধুরী, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টার ঐক্য পরিষদের সভাপতি নিম চন্দ্র ভৌমিক উপস্থিত ছিলেন।