নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন চাইলেও যে আইন হতে যাচ্ছে, তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী শাহদীন মালিক।
Published : 27 Jan 2022, 03:40 PM
তিনি বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের খসড়া প্রকাশের পর যেসব আলোচনা হচ্ছে, তাতে ঘুরেফিরে একটাই আসছে, এটা অস্বচ্ছ। সরকারের অনুগত পক্ষের কমিটি দ্বারা কী নির্বাচন কমিশন গঠন হবে, সেটা আমাদের সবার কাছে বোধগম্য।”
বৃহস্পতিবার ঢাকার পুরানা পল্টনে মুক্তি ভবনে ‘প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন আইন-জনপ্রত্যাশা ও করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে একথা বলেন ইসির সাবেক আইনজীবী শাহদীন মালিক। বাম গণতান্ত্রিক জোট এ সভার আয়োজন করে।
এই সভা চলার মধ্যেই সংসদে পাস হয় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ’ আইন।
গত ৫০ বছরে ইসিতে নিয়োগে কোনো আইন না থাকায় বরাবরই ইসি গঠনের সময় বিতর্ক দেখা দিচ্ছিল। তা এড়াতে ২০১২ সালে নতুন কমিশন নিয়োগের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সার্চ কমিটি নামে একটি মধ্যস্থ ফোরাম তৈরি করলেও বিতর্ক থামেনি।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবারও সেই পথে এগোচ্ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষ করার আগেই আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়, যাতে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের বিধান রয়েছে।
ইসি গঠনের আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তুলনা করে শাহদীন মালিক বলেন, “ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বলা হল এক কথা, কম্পিউটার হ্যাকিং … কিন্তু আইন করা হল বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করার জন্য।”
ইসি গঠনের আইনও তাই হতে যাচ্ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বলে দিলেই তো হত। অন্তত এই স্বচ্ছতা কি আমরা আশা করতে পারি না?”
শাহদীন মালিক বলেন, “আমি বসে বসে ভাবছিলাম, মাননীয় সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বলতে পারি, পরিবর্তনগুলো কিছুই তো আপনারা আনবেন না। শুধু একটা যদি পরিবর্তন আনতে পারেন… আইনের প্রথম ধারায় আইনের শিরোনাম ও কার্যকারিতা উল্লেখ থাকে, আইনের নাম বদলে দেওয়া যায় কি না। আমি প্রস্তাব করব- আগামী পাঁচ বছরের নির্বাচনসমূহে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিশ্চিতকরণ আইন’।
“এটা বললে আমরা অন্তত আশ্বস্ত হতাম। সরকারের উদ্দেশ্যে খোলাসা করে বলার জন্য বাহবা দিতাম, ধন্যবাদ জানাতাম। অন্তত সরকার একটা জায়গায় হলেও যা করছে এবং মুখে যা বলছে, একটা সঙ্গতি আছে।”
তার এই কথা শুনে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া অন্যরা হাসতে থাকেন।
পৃথিবীর ৩০টি দেশে এক ব্যক্তি সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ৩০ বছর ধরে নির্বাচিত হচ্ছেন জানিয়ে শাহদীন মালিক বলেন, “এসব কর্তৃত্ববাদী সরকারে সব সময় একটা ব্যাপারে প্রচণ্ড সাফল্য থাকে, তারা এমনভাবে নির্বাচন করে যাতে ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখে।
“আমরাও এখন সম্পূর্ণ কর্তৃত্ববাদী সরকারে আছি। নির্বাচন একটা হবে, নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, সেটা নিশ্চিত করার যেই কৌশল এই সরকার সম্পূর্ণ আয়ত্ত করেছে।”
নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজটিও সরকারের ‘একক কর্তৃত্বে’ চলে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এই সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমরা বহুদিন থেকেই নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে দাবি করে আসছি। কিন্তু হঠাৎ করে অংশীজনদের সাথে আলাপ-আলোচনা না করেই মন্ত্রিসভায় এটার বিল উত্থাপন করে আইন পাস করতে যাচ্ছে।”
যে সার্চ কমিটির কথা আইনে বলা হয়েছে, তা অনেকটা অস্বচ্ছ থাকছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখানে পুরোটাই হবে অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদেই নিয়োগ হবে।”
সংবিধানের ৪৮তম অনুচ্ছেদে রয়েছে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন রাষ্ট্রপতি।
সার্চ কমিটি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রস্তাব করা নামের তালিকা প্রকাশের ব্যবস্থা রাখার দাবি জানান বদিউল আলম মজুমদার।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ বলেন, “দ্রুতগতিতে এই আইন তৈরি করা হচ্ছে। যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আস্থাহীনতা আছে, সেই জন্য ক্ষমতাসীনরা সেই আস্থা তৈরি করে আইনটি করার উদ্যোগ নেওয়ার উচিৎ ছিল।”
সভায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, “যে সংসদের কোনো রাজনৈতিক বৈধতা নেই, সেই সংসদে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করার নৈতিক কর্তৃত্ব ও যোগ্যতা রাখে না।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে যে সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, তার পক্ষে সরকারি দলের ‘নীলনকশার’ বাইরে যাওয়ার সুযোগ সেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংসদে আনা এই বিল প্রত্যাহার করে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বাম নেতা সাইফুল, যদিও ততক্ষণে সংসদে আইনটি পাস হয়ে যায়।