যে কোনো লঞ্চে ইঞ্জিন রুমেই থাকে অগ্নি নেভানোর যন্ত্র; সেটা অভিযান-১০ লঞ্চেও ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু আগুন লাগার পর অ্যাশটিংগুইশার দিয়ে তা নেভানোর চেষ্টার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
Published : 26 Dec 2021, 09:15 PM
অন্ধকারে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো খুঁজতে সমস্যা হয়েছিল বলে লঞ্চটির সুপারভাইজার আনোয়ার হোসেন দাবি করেছেন। তবে অন্য লঞ্চকর্মীদের কথা তার সেই দাবিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চ অভিযান-১০ ঝালকাঠিতে সুগন্ধা নদী অতিক্রমের সময় শুক্রবার ভোররাতে এতে আগুন লাগে। এতে অন্তত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহতও হয়েছে বহু।
যতদূর জানা গেছে, ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছিল। লঞ্চের ইঞ্জিনে ত্রুটি, তাতে গা না করা, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম ব্যবহার না করাসহ নানা অভিযোগ ইতোমধ্যে উঠেছে।
লঞ্চটির সুপারভাইজার আনোয়ার হোসেন শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, লঞ্চের বাতি প্রথমে নিভে গিয়েছিল, পরে তারা ইঞ্চিন রুমে আগুন দেখেন।
“ড্রাইভার কালাম আর গ্রিজারম্যান সুমন দৌড়ে বলতেছিল ‘বোতল কই, বোতল কই (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র)’। সুমন বলতেছিল, অন্ধকারে কিছু দেখতেছি না।”
লঞ্চে ইঞ্জিন রুম থাকে নিচতলায়; তিন তলা অভিযান-১০ এও তা ছিল নিচতলার ডেকের পাশে।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের পরিদর্শক হাবিবুর রহমান রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে বলেন, অভিযান-১০ লঞ্চে নিরাপত্তা বিষয়ক সব সরঞ্জামই ছিল।
অভিযান-১০ লঞ্চের ফিটনেস ও সার্ভের সার্টিফিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে সমুদ্র পরিবহনের প্রধান প্রকৌশলী মঞ্জুরুল কবিরও বলেন, ফিটনেস ও সার্ভে সার্টিফিকেট ছিল অভিযান-১০ লঞ্চের।
তবে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কেন খুঁজতে হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আরেকটি লঞ্চের ৬০ বছর বয়সী অভিজ্ঞ ইঞ্জিন ড্রাইভার আব্দুল জব্বার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইঞ্জিন কক্ষে আগুন লাগলে চোখ বন্ধ করেই সেগুলো (অগ্নিনির্বাপকযন্ত্র) নেওয়া যায়। এটা খোঁজার জন্য বাইরে যেতে হয় না।
“অভিযান-১০ লঞ্চে আসলে কী হয়েছিল, বুঝতেই পারছি না। সুমনকে বাইরে এসে কেন যন্ত্র খুঁজছিল?”
জব্বার বলেন, একজন ড্রাইভার আর দুইজন গ্রিজারম্যানকে সব সময় ইঞ্জিন কক্ষে থাকতে হয়। আর এই তিনজনকে আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে দক্ষ হতে হয়।
রোববার ঢাকার সদরঘাটে কয়েকটি লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, কক্ষের চারপাশে চারটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে এই যন্ত্রগুলো নেওয়া যায়।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযান-১০ লঞ্চের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্টির কথা বললেও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলছেন ভিন্ন কথা।
তিনি রোববার সাংবাদিকদের বলেন, তিন তলা ওই লঞ্চের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা।
“আমরা প্রাথমিকভাবে যেটা বলতে পারি, এই লঞ্চের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা তেমন কার্যকর ছিল না এবং যারা দায়িত্বে ছিল, তারা এটা ম্যানেজ করতে পারেনি। এমনিতে নদীর ভেতরে কোনো নৌযানে আগুন লাগলে তা নেভানো সহজ হওয়ার কথা, যদি ফায়ার পাম্প ও হোসপাইপের ব্যবস্থা ঠিকঠাক থাকে। কিন্তু অভিযান-১০ লঞ্চের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি।”
অভিযান-১০ লঞ্চের সব ঠিকঠাক আগে বললেও নৌ আদালতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শফিকুর রহমান যে মামলা করেছেন, তাতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা অপ্রতুলতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযান লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের পর রোববার সদরঘাটে গিয়ে অন্য লঞ্চগুলোতে বয়া ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসহ নিরাপত্তা সরঞ্জাম দৃশ্যমান।
আগে তেমনটি ছিল না বলে যাত্রীরা বললেও এসব লঞ্চের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, আগে থেকেই তা ছিল।
লঞ্চগুলোর নিচতলায় পেছনে ইঞ্জিন কক্ষের পাশে রান্নার ঘর, আর রান্না চলে গ্যাসে, ফলে থাকে গ্যাসের সিলিন্ডার।
তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে একজন যাত্রী বলেন, “কতগুলা সিলিন্ডার। যদি একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে……?”
যাত্রার শুরুর ঘোষণাই ফাঁকি
যে কোনো লঞ্চ ঘাট ছাড়ার আগে কিছু তথ্য দিতে হয় বিআইডব্লিউটিএকে। তারপর ছাড়পত্র পেলেই যাত্রা শুরু করতে পারে।
রোববার ঢাকার সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বিআইডব্লিউটিএ পরিদর্শক একটি কক্ষে বসে আছেন। একটি লঞ্চের কর্মচারী একটি কাজ নিয়ে আসলেন, যেটাকে ‘ভয়েজ অব ডিক্লারেশন’ বলে।
লঞ্চের মাস্টার কে, ড্রাইভার কে, যাত্রী কতজন- তা লেখা থাকে ওই ঘোষণাপত্রে। লঞ্চ কর্মচারী সব তথ্য পূরণ করে আনলে যাচাই করে পরিদর্শক তাকে স্বাক্ষর করেন।
লঞ্চ কর্মচারী যে যাত্রী সংখ্যা দিয়েছে, তা যাচাই করেছেন কি না-জানতে চাইলে পরিদর্শক নিয়াজ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি যাত্রী সংখ্যা দেওয়ার পর আমি বা আমার অন্য সদস্য সরেজমিন দেখে যদি তথ্য সত্য হয়, তাহলে স্বাক্ষর করি। আর যাত্রী সংখ্যা বেশি মনে হলে ঠিকমতা লিখতে বলা হয়।”
অভিযোগ রয়েছে, যাত্রী সংখ্যা লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যা লিখে দেয়, তাতেই স্বাক্ষর করা হয়। আর এতে টাকার বিনিময়ও হয়।
তবে টাকার বিনিময়ে ‘ভয়েজ অব ডিক্লারেশন’ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন বিআইডব্লিউটিএর পরিদর্শকরা।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিআইডব্লিউটিএ পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বিষয়টির উপর তারা আরও ‘ভালোভাবে নজর দেবেন’।