এসব ইঞ্জিনের ছোটখাটো সমস্যা মেরামতে লঞ্চে সার্বক্ষণিক কারিগরও (টেকনিশিয়ান) থাকতেন। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতেও ইঞ্জিনরুমে তারা কাজ করছিলেন। নানাভাবে চালিয়ে ইঞ্জিনগুলোর 'ট্রায়াল’ দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন লঞ্চটির কর্মীদের কয়েকজন।
বেঁচে যাওয়া যাত্রী, ফায়ার সার্ভিস ও র্যাবের কর্মকর্তাদের প্রাথমিক ধারণা, ইঞ্জিন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। তবে লঞ্চের মালিক মো. হামজালাল শেখ বলছেন, ইঞ্জিনে কোনো ত্রুটি ছিল না।
কোভিড মহামারীর ঠিক আগে তৈরি অভিযান- ১০ লঞ্চটি ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে ঝালকাঠির গাবখানের কাছাকাছি সুগন্ধা নদীতে থাকা অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত ৩টার পর আগুনে পুড়ে যায়। এতে এখন পর্যন্ত ৩৭ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। আহত হয়ে ৮০ জনের বেশি চিকিৎসাধীন হাসপাতালে।
লঞ্চ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৈরির পর থেকেই ভাগ্য সহায় হয়নি অভিযান- ১০ এর। ২০২০ সালে পানিতে ভাসার সময় শুরু হয় মহামারী। যে দুটো রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন এটিতে লাগানো হয়েছিল সেগুলো পূর্ণ আরপিএম (প্রতি মিনিটে ঘুর্ণন) এ চাহিদামত গতি দিচ্ছিল না। ফলে ইঞ্জিন বদলানোর সিদ্ধান্ত নেয় মালিক পক্ষ।
তিনি বলেন, “নতুন ইঞ্জিন লাগিয়ে চলতি মাসেই সার্ভিসে নামে লঞ্চটি। দুটি রিকন্ডিশন্ড ডাইহাট্সু ইঞ্জিন লাগানো হয়েছিল।“
তার দাবি, ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা ছিল না। বড় চার তলা লঞ্চে যেসব ইঞ্জিন লাগানো হয়, তিনিও সেই একই ইঞ্জিন লাগিয়েছিলেন।
তবে ওই লঞ্চ পরিচালনায় যুক্ত একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০২০ সালে তৈরির পর মহামারীর ধাক্কায় লঞ্চটি ট্রিপে যেতে পারেনি। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর যখন থেকে ট্রিপে যেতে শুরু করল, তখন দেখা গেল ইঞ্জিন ঠিকমতো কাজ করছে না। ফুল আরপিএম এ ইঞ্জিন চালিয়েও দেখা যাচ্ছে লঞ্চ গতি পায় না। গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়।
বিষয়টি জানানোর পর মালিকপক্ষ লঞ্চের ইঞ্জিন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি বছরের নভেম্বরে লঞ্চটি মাদারীপুরের একটি ডক ইয়ার্ড তোলা হয়। আগের ইঞ্জিনের চেয়ে বেশি হর্সপাওয়ারের দুটি রিকন্ডিশন্ড ডাইহাট্সু মেরিন ইঞ্জিন লাগানো হয়।
নতুন ইঞ্জিন লাগিয়ে চলতি মাসেই যাত্রী পরিবহনে নিয়মিত হয় লঞ্চটি। নতুন ইঞ্জিন লাগানোর পরও নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য লঞ্চের সার্বক্ষণিক টেকনিশিয়ান থাকতেন বলে জানান কর্মীরা।
ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, লঞ্চের ইঞ্জিনরুমের অংশটি বেশি পুড়েছে। সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তারা।
এ লঞ্চ দুর্ঘটনার বিষয়ে র্যাবের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও বলা হয়েছে, ইঞ্জিন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে।
তবে ইঞ্জিনে কোনো ত্রুটি ছিল না দাবি করেন হামজালাল যিনি এমভি অভিযান-১০ ছাড়াও অভিযান- ৩ ও ৫ লঞ্চের মালিক।
তিনি বলেন, ইঞ্জিনরুম বেশি পুড়েছে তার কারণ হচ্ছে সেখানে ছয় হাজার লিটার তেল ছিল। তবে ইঞ্জিনে কোনো ত্রুটি ছিল না।
যাত্রীদের অনেকেই আগুনের আগে বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েছেন। যাত্রী আব্দুর রহিম জানান, রাতে ডেক থেকে তিনি হঠাৎ বিকট শব্দ পান। তীব্র আতঙ্কে তিনি ডেক থেকে নদীতে লাফ দেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “লঞ্চের ইঞ্জিনের যে একজস্ট পাইপ (পোড়া ধোঁয়া বের হওয়ার পাইপ) ওপরের দিকে গেছে সেখানে প্রথম বিস্ফোরণ হয় বলে আনোয়ার আমাকে জানিয়েছে।“
মেরিন (সামুদ্রিক) যানবাহনের যন্ত্রাংশের ব্যবসায় যুক্ত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ দিলির দাইয়ান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সাধারণত কোনো বড় নৌযানে ইঞ্জিন লাগানোর পর এটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কয়েকটি প্যারামিটার নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে।
এগুলোর মধ্যে থাকে নৌযানের ইঞ্জিনের তাপমাত্রা, একজস্ট এর তাপমাত্রা, সি ওয়াটার প্রেসার (ইঞ্জিন ঠাণ্ডা করায় ব্যবহার করা হয়), কম্প্রেশন রেশিও ইত্যাদি। এ প্যারামিটারগুলো ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক কোম্পানির নির্ধারিত মাত্রায় হলে ইঞ্জিনটিকে কমিশনিং করা হয়।
তিনি বলেন, এছাড়া ইঞ্জিন চালু করার যে ব্যাটারি তার সংযোগ আলগা থাকলে বা ব্যাটারিতে নির্ধারিত মানের তার ব্যবহার করা না হলে সেখান থেকে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। যেখান থেকে নৌযানে আগুন লাগার আশঙ্কা রয়ে যায়।
আরও পড়ুন: