অভিযান-১০: ইঞ্জিন রুমে আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল, মেলেনি উত্তর

দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হল ঝালকাটির সুগন্ধা নদী; চলন্ত লঞ্চে পুড়ে অঙ্গার হল তিন ডজন প্রাণ। 

কামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Dec 2021, 07:38 PM
Updated : 25 Dec 2021, 09:30 AM

ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকেই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসার পর ইঞ্জিনে ‘সমস্যা হচ্ছিল’ বলেও জানিয়েছেন বেঁচে যাওয়া কয়েকজন যাত্রী।

তবে লঞ্চ মালিকের দাবি, এ মাসেই লাগানো রিকন্ডিশনড ইঞ্জিনে কোনো ‘ত্রুটি ছিল না’। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইঞ্জিন রুমের কাছে রাখা কয়েক হাজার লিটার তেল। লঞ্চে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো ব্যবহারের ‘সময় পাওয়া যায়নি’।

তাহলে কীভাবে আগুন লেগেছিল সেখানে? কীভাবে তা এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারল? ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে তদন্তের পর।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা সদরঘাট থেকে কয়েকশ যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছিল এমভি অভিযান-১০। চাঁদপুর, বরিশাল ও দপদপিয়া ঘাট পেরিয়ে লঞ্চটি যাচ্ছিল বেতাগী, শেষ গন্তব্য ছিল বরগুনা; শীতের রাতে যাত্রীদের অধিকাংশই ছিলেন ঘুমে। 

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আগুন লেগে পুড়ে যায় ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চ অভিযান-১০।

রাত ৩টার দিকে কোনো এক সময় চলন্ত লঞ্চে আগুনের সূত্রপাত হয়। ওই অবস্থাতেই এগিয়ে যেতে থাকে অভিযান-১০, এক পর্যায়ে পুরো লঞ্চ পরিণত হয় নরককুণ্ডে।

রাতের কুয়াশা ঝেটিয়ে সুগন্ধা নদী আলোকিত করে তোলে সেই আগুন, প্রাণ বাঁচাতে নদীর শীতল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন যাত্রীদের অনেকে। আগুন দেখে ছুটে আসেন আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা। 

প্রাণ বাজি রেখে সেই ঝাঁপ অনেককে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এগিয়ে গিয়ে তাদের তুলে এনেছেন স্থানীয়রা। ফায়ার সার্ভিস, নৌ পুলিশ ও কোস্ট গার্ডও অংশ নিয়েছে উদ্ধার অভিযানে।

কিন্তু উপরের দুই তলার বন্ধ কেবিনে যারা ঘুমাচ্ছিলেন, তাদের অনেকের আর বের হওয়ার সুযোগ হয়নি। সেই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিটের সময় লেগেছে প্রায় তিন ঘণ্টা।

শুক্রবার দিনভর তল্লাশি চালিয়ে পোড়া লঞ্চ আর নদী থেকে ৩৬ জনের লাশ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস। ঢাকায় নেওয়ার পথে মৃত্যু হয়েছে দগ্ধ এক শিশুর। আর ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনিস্টিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে এক প্রৌঢ়ের।

অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক ৩৫ জনের লাশ উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন। ঝালকাঠির ডিসি মো. জোহর আলীও বলেছেন, উদ্ধারকারীরা মোট ৩৫টি বডিব্যাগ তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, সেগুলো পাঠানো হয়েছে ঝালকাঠি সড়র হাসপাতালের মর্গে।

তবে কোনো ব্যাগে একাধিক পোড়া লাশও থাকতে পারে জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। উদ্ধার করা লাশগুলোর অধিকাংশই এতটা পুড়ে গেছে যে সেগুলো চেনার উপায় নেই।

ওই লঞ্চে কত যাত্রী ছিলেন, তা নিয়ে এসেছে বিভিন্ন রকম তথ্য। বিআইডব্লিউটিএ বলেছে, ঢাকা থেকে ছাড়ার সময় সেখানে চারশর মত যাত্রী ছিল। কিন্তু বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা আটশ থেকে হাজার আরোহী থাকার কথা বলেছেন। 

তাদের মধ্যে দগ্ধ ও আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। ৮১ জনকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে, তাদের দশজনকে ঢাকায় পাঠানোর কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চ অভিযান-১০ থেকে হতভাগ্য যাত্রীদের মরদেহ বের করে আনছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

বাংলাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনা নতুন নয়, দুই নৌযানের সংঘর্ষ কিংবা ডুবের যাওয়ার ঘটনায় প্রতিবছরই বহু মৃত্যুর খবর আসে। কখনও কখনও অগ্নিকাণ্ডও ঘটে। কিন্তু লঞ্চে আগুন লেগে এত মৃত্যু আর কখনও ঘটেনি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভয়ঙ্কর ওই অগ্নিকাণ্ডকে ‘রহস্যজনক’ বলছেন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এভাবে আগুনটা ছড়িয়ে যাবে, আমার কাছে বিষয়টি অ্যাবনরমাল মনে হয়েছে। এত দ্রুত…। এভাবে আগে কখনও আগুন ধরেনি। আমাদের কাছে বিষয়টা ‘কনফিউজিং’।

“তবে অনেকে বলেছে যে সময় ক্ষেপণ হয়েছে। আসলে একেকজন একেক কথা বলছে। দেখা যাক তদন্তে কী আসে।”

নজিরবিহীন

ফায়ার সার্ভিস অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগার খবর পায় রাত সাড়ে ৩টার দিকে। তাদের প্রথম দলটি ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ২০ মিনিটের মাথায়। বরিশাল ফায়ার সার্ভিসের সহকারী উপ-পরিচালক মো. বেলাল হোসেন সেখানে পৌঁছান শুক্রবার ভোর ৬টার দিকে।

সারা দিন উদ্ধার অভিযান শেষে রাতে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ফায়ার স্টেশনের অফিসার হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতায় লঞ্চে ছোটখাটো আগুন অনেকবারই তিনি দেখেছেন। কিন্তু এমন ভয়াবহ আগুন কখনও দেখেননি।

“ভোর ৬টার সময়ও ইঞ্জিন কক্ষ দাউ দাউ করে জ্বলছিল। লঞ্চ স্পর্শ করা যাচ্ছিল না, এত গরম। আস্তে আস্তে পানি দিতে দিতে লঞ্চে উঠেছি আমরা। দেখে মনে হয়েছে যেন পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

ঝালকাঠির দিয়াকুল এলাকায় সুগন্ধা নদীর তীরে ভেড়ানো আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চ অভিযান-১০। মাঝ রাতে লাগা আগুনে প্রায় সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে তিনতলা লঞ্চটি। ছবি: হাসিবুল ইসলাম হাসান

ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, পুরো লঞ্চ এতটাই পুড়ে গেছে যে বাইরে থেকে নামও পড়া যাচ্ছিল না। কাঠামো ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না।

লঞ্চ মালিক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদলের বয়স প্রায় সত্তর। এ খাতে কাজ করছেন প্রায় ৫০ বছর ধরে। তিনিও বলেছেন, “লঞ্চে এমন আগুন কোনো দিন দেখিনি। আগুনে এত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি “

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জুবায়ের ইবনে আউয়াল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সমুদ্রগামী জাহাজে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড বেশ কয়েকবারই ঘটেছে। তবে নদীপথে যাত্রাবাহী লঞ্চে এমন তীব্র আগুনের ঘটনা আর নেই।

“আগুনের অনেকগুলো ছবি পেয়েছি, টেলিভিশনেও দেখছি। লঞ্চের মধ্যে কালো কালো দাগ দেখে মনে হচ্ছে, আগুন সহায়ক অনেক কিছুই ছিল ওই লঞ্চে।”

আগুনের সূত্রপাত কীভাবে?

কীভাবে ওই লঞ্চে আগুন লেগেছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বার বার এসেছে ইঞ্জিন রুমের কথা। ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করা ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম বলেছেন, লঞ্চের ইঞ্জিনরুমের অংশটি বেশি পুড়েছে। সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে বলে তাদের ধারণা।

যাত্রীদের অনেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার কথা বলেছেন। আব্দুর রহিম নামের এক যাত্রী বলেছেন, রাতে ডেক থেকে তিনি হঠাৎ বিকট শব্দ পান। তারপর দ্রুত আগুন গ্রাস করে ফেলে পুরো লঞ্চ। আতঙ্কিত হয়ে তিনি ডেক থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন।

লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখও বলেছেন, লঞ্চের কেরানী আনোয়ার ভোরে আগুন লাগার খবর দেওয়ার সময় ইঞ্জিনের একজস্ট পাইপের কাছে বিস্ফোরণের কথা তাকে জানিয়েছিলেন।

বেঁচে ফেরা যাত্রীদের মধ্যে যারা নিচের ডেকে ইঞ্জিন কক্ষের কাছাকাছি ছিলেন তাদের কয়েকজন বলেছেন, ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার পরপরই ইঞ্জিনে গোলযোগ দেখা দেয়। সে কারণে কয়েকজন টেকনিশিয়ান কয়েক দফা সেটা সারানোর চেষ্টা করছিলেন। দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে দ্রুত গতিতে ছোটানো হচ্ছিল লঞ্চ।

মো. আবদুল্লাহ নামের এক যাত্রী বলেছে,প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠেছিল ইঞ্জিন কক্ষের আশপাশের এলাকা। তার ধারণা, তাপ বেড়ে গিয়েই ইঞ্জিনে আগুন লেগে থাকতে পারে। আগুন লাগার পর লঞ্চের কর্মীরা সেখান থেকে সরে পড়েন।

পরে আরও অনেকের মত নদীতে ঝঁপিয়ে পড়ে প্রাণে বাঁচার কথা জানিয়েছেন আবদুল্লাহ। 

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চ অভিযান-১০ থেকে উদ্ধার করা মরদেহ শনাক্তের জন্য রাখা হয়েছে তীরে। ছবি: হাসিবুল ইসলাম হাসান

তবে ইঞ্জিনে কোনো ত্রুটি ছিল না দাবি করে লঞ্চ মালিক হামজালাল শেখ বলেছেন, নতুন ইঞ্জিন লাগিয়ে চলতি মাসেই সার্ভিসে নামে তার লঞ্চ। দুটি রিকন্ডিশন্ড ডাইহাটসু ইঞ্জিন লঞ্চটিতে লাগানো হয়েছিল। ইঞ্জিনরুম বেশি পুড়েছে কারণ সেখানে ছিল ছয় হাজার লিটার তেল।

নিচের ডেকের ইঞ্জিন কক্ষের পাশেই ছিল লঞ্চের ক্যান্টিন। সেখানে গ্যাস সিলিন্ডার ‘বিস্ফোরিত হয়ে’ আগুন লেগেছে বলে এক কেবিন বয়ের বরাতে খবর দিয়েছে একটি সংবাদমাধ্যম।

ওই কেবিন বয় বলেছেন, বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে আগুন ধরে যায় এবং তা দ্রুত ইঞ্জিনরুমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে রাখা ১৩ ব্যারেল ডিজেল আগুন বাড়িয়ে দেয়।

তবে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ার ধারণা সঠিক নয় বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের বরিশাল বিভাগীয় প্রধান মো.কামাল হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই তথ্য সত্য নয়। আমি নিজেই ইঞ্জিন কক্ষের কাছে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার অক্ষত অবস্থায় দেখেছি। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোনো চিহ্ন আমরা সেখানে দেখিনি।”

তাহলে আগুন কেন এবং কীভাবে লাগল- সেই প্রশ্নে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসেইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণ করা হচ্ছে ইঞ্জিন কক্ষ থেকেই আগুনের সূত্রপাত।”

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের কথায় বিস্ফোরণের বিষয়টি এসেছে। এখন সেটা আগুন লাগার পর হয়েছে না আগে- তদন্ত না করে তা বলা সম্ভব না।  

অগ্নি নিরাপত্তা কতটা ছিল?

বুয়েটের নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জুবায়ের ইবনে আউয়াল বলছেন, লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষে আগুনের ঘটনা আগেও ঘটেছে।তবে সেখানে আগুন নির্বাপক যন্ত্র দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিভিয়ে ফেলায় বড় বিপদ হয়নি, এত খবরও হয়নি।

“লঞ্চের ডেকোরেশনে অনেক দাহ্য পদার্থ থাকে, কাডবোর্ড থাকে। শীতকাল আগুনের সহায়ক অনেক কিছুই ছিল যাত্রীদের কাছে। যেমন শীতের লেপ, কম্বল ও পোশাক। আর কেউ ইলেকট্রিক হিটার বহন বা ব্যবহার করছিল কিনা তাও তদন্ত করে দেখতে হবে।

অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে লঞ্চের নিখোঁজ যাত্রীদের সন্ধানে স্বজনরা। ছবি: হাসিবুল ইসলাম হাসান

“কোনো একজন সিগারেট খেয়ে কোন স্থানে ফেললেও বড় বিপদের কারণ হতে পারে। আগুনের তীব্রতা দেখে মনে হচ্ছে লঞ্চের কোথাও কিছু দাহ্য পদার্থ ছিল যা থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।… আমি শুধু সম্ভাব্য কারণ বলছি। তদন্তেই উঠে আসবে প্রকৃত কারণ।”

লঞ্চ মালিক সমিতির নেতা বদিউজ্জামান বাদল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইঞ্জিন কক্ষে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে তা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে। সেখানকার অনেক কিছু বেঁকে যাবে।

“লঞ্চটিতে দুই মাস আগে রঙসহ কেবিনের ও ইঞ্জিনের কাজ করেছে। কেবিনের কাজ করতে গিয়ে কাঠ আর আঠালো পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে যা আগুনকে আরো তীব্র করে।”

অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখ দাবি করেছেন, আগুন নেভানোর অন্তত ২১টি যন্ত্র ছিল ওই লঞ্চে। আর সেগুলো ব্যবহারের প্রশিক্ষণও কর্মীদের ছিল। তবে সেগুলো ব্যবহারের সময় পাওয়া যায়নি। 

আগুনে নেভানোর পর লঞ্চের ভেতরে অগ্নি নিরাপত্তার কতটা ব্যবস্থা দেখা গেছে- তা বরিশাল ফায়ার সার্ভিসের সহকারী উপ-পরিচালক মো. বেলাল হোসেনের কাছে জানতে চেয়েছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

উত্তরে তিনি বলেন, “ইঞ্জিন কক্ষের সামনে একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র পড়ে ছিল। তবে সেটা ব্যবহার করা হয়নি। পুরো লঞ্চে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা কতটা কী ছিল, সেটা তদন্তের পর বলা যাবে।”

অভিযান-১০ লঞ্চের ডেকে রাখা খাবার ও মালপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে মাঝ রাতের লাগা আগুনে প্রায় সম্পূর্ণ পুড়ে যায় তিনতলা লঞ্চটি; প্রাণহানিও হয়েছে ব্যাপক। ছবি: হাসিবুল ইসলাম হাসান

আলোচনায় ইঞ্জিন

নৌ পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লঞ্চের নতুন ইঞ্জিন অনেক সময় ঠিকমত কাজ করে না, বেশ কিছুতিন ট্রায়ালে রাখার প্রয়োজন হয়। সে কারণে জাহাজ থেকে রিকন্ডিশনড ইঞ্জিন এনে দূরপাল্লার লঞ্চে ব্যবহার করা হয়।

যাত্রীবাহী লঞ্চ ব্যবস্থাপনায় যুক্ত একটি কোম্পানির একজন মহাব্যবস্থাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রায় সব লঞ্চে শিপ থেকে রিইউজেবল ইঞ্জিন এনে লাগানো হয়। পুরনো ইঞ্জিন বলে কিছু নেই। আমরা নতুন নতুন পার্টস এনে ইঞ্জিন নতুন করে ফেলি। তাতে ইঞ্জিনের মেয়াদও বাড়ে।”

বুয়েটের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশলের শিক্ষক জুবায়ের ইবনে আউয়াল বলছেন, ইঞ্জিনব্লক (স্ট্রাকচার) ঠিক রেখে যন্ত্রাংশ বদলে ইঞ্জিন ওভারহলিং করা নিয়মিত একটি বিষয়। তবে সেটা ঠিকমত না হলে সমস্যা হতে পারে।

ইঞ্জিনব্লক ঠিক থাকলে ভেতরের মুভিং পার্টস পরিবর্তন করে দীর্ঘদিন চালানো সম্ভব বলে জানান এ প্রকৌশলী। 

তিনি বলেন, “আমাদের এখানে লঞ্চ বা জাহাজের ইঞ্জিন থেকে সব সময় তেল চুইয়ে পড়ে। এটা দেখভাল করার জন্যে একজন ওয়াচার সবসময় থাকতে হয়। কক্ষটি পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়।”

এ নৌযান বিশেষজ্ঞ বলেন, পৃথিবীর সব বড় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত খুব ছোট এজিনিস থেকে। যেমন সিগারেট। ইঞ্জিন ঘরের বাইরে থেকে অসাবধানতাবশত কেউ সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ফেললে, সেটা তেলের সংস্পর্শ পেলে বিপদ ঘটতেই পারে।এখানে ওয়াচার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিনরুমের ব্যবস্থাপনা কেমন ছিল? মালিক হামজালালের দাবি, তার লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষে একজন ইঞ্জিন ড্রাইভার ও দুইজন গিজারম্যান পালা করে সর্বক্ষণ দায়িত্ব পালন করেন।

ঝালকাঠির দিয়াকুল এলাকায় সুগন্ধা নদীর মাঝে আগুনে পুড়ে যাওয়া অভিযান- ১০ লঞ্চের একটি কেবিনের মেঝেতে পোড়া মালপত্রের ছাই ও ফ্যানের কিছু অংশ। ছবি: হাসিবুল ইসলাম হাসান

তদন্ত কমিটি

অগ্নিকাণ্ডের খবরে সকালেই ঢাকা থেকে ঝালকাঠিতে যান প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিআইডব্লিউটিএ আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি করার ঘোষণা দেয়।

অভিযান-১০ লঞ্চের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ লঞ্চটির ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদ আছে ২০২২ সাল পর্যন্ত। ফিটনেস সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে কোনো দুর্বলতা থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে।

অগ্নিকান্ডে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে সরকার দেড় লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেবে বলে জানান তিনি।