নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘কাঠামোগত হত্যা’ বলে বিশিষ্ট ১৯ জন নাগরিক নিয়ে গঠিত ‘নাগরিক তদন্ত কমিটি’।
Published : 31 Aug 2021, 03:37 PM
এছাড়া এ ঘটনার জন্য কারখানার মালিক এবং সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দায়ী বলেও মনে করছে এ তদন্ত কমিটি।
মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটির আহ্বায়ক আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া কমিটির প্রতিবদেন তুলে ধরেন।
গত ৮ জুলাই হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে সরকারি হিসাবে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলা হলেও নাগরিক তদন্ত কমিটি বলছে, এতে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৩৩ জন শ্রমিক।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “নাগরিক তদন্ত কমিটি মনে করে সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠা পরিদর্শন অধিদপ্তরের কারখানা পরিদর্শকরা যদি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতেন এবং হাসেম ফুডসের মালিক কলকারখানা প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার সকল নিয়ম ও বিধিবিধান মেনে চলতেন তাহলে এই ব্যাপক হতাহতের দায় এড়াতে পারত। এই মৃত্যুর দায় এসব পক্ষ তাই কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
“এটিকে আমরা দুর্ঘটনা না বলে কাঠামোগত হত্যা বলে চিহ্নিত করছি এবং সেভাবেই দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক বলে মনে করছি।”
হাসেম ফুডস কারখানায় কীভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সেই বিষয়ে কোনো তথ্য না থাকলেও আগুন লাগার জন্য দুটি কারণ দায়ী বলে জানান তিনি।
“প্রথমত ভবনটিতে ফায়ার অ্যালার্ম ছিল না। এর ফলে আগুন লাগার অব্যবহিত পরই তা কেউ টের পায়নি। কর্মীরা মূলত দেখে ও পরস্পরের কাছ থেকে শুনে জানতে পেরেছেন। এক্ষেত্রে কাজে ব্যস্ত থাকাতে অনেক কর্মী জানালার ঠিক বাইরেই আগুন এসে পড়লেও টের পাননি।
“আর দ্বিতীয় ভবনটিতে আগুনরোধী সিঁড়ি ছিল না। ভবনের দুটি সিঁড়িই পরিকল্পনা অনুযায়ী আগুনরোধী উপকরণ দিয়ে মূল অংশ থেকে আলাদা। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিঁড়ি তৈরি করা থাকলে সেখানে ধোঁয়া ঢুকতে পারত না। কর্মীরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে পারতেন।”
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চার দফায় এ কারখানায় সেফটি প্ল্যান ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নোটিস দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এর মধ্যে কারখানাটিকে ক্রুটিপূর্ণ ফায়ার সেফটি প্ল্যানকে সাময়িকভাবে অনুমোদন দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস।
আগুন লাগার ঠিক চারদিন আগে ৪ জুলাই সর্বশেষ নোটিসে হাসেম ফুড কারখানাকে ১৯টি শর্ত পূরণের তাগিদ দেওয়া হয়।
নাগরিক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সর্বশেষ নোটিসের প্রেক্ষিতে শিল্প প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক তারেক ইব্রাহিম ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি অঙ্গীকারনামা প্রদান করেন। সেখানে পরিচালক অঙ্গীকার করেছেন, অগ্নিকাণ্ডসহ যেকোনো দুর্ঘটনায় জানমালের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে দায়ভার বহনসহ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তা মেনে নিতে বাধ্য থাকবে।
তিনি বলেন, “ফায়ার সার্ভিস অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে হলফনামার মাধ্যমে অগ্নি নিরাপত্তার ‘অঙ্গীকারনামা’ নিয়েছে। অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরণের হলফনামা নেওয়ার কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
“এভাবে হলফনামা নেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নিজেদের উপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়।”
কারখানাটিতে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুরা কাজ করত এবকং কারও কারও জাল জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়ে ১৪ কিংবা ১৮ বছরের বেশি দেখিয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করত কিছু অভিভাবক।
এভাবে শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত করে কারখানা কর্তৃপক্ষ এ দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
ইতোমধ্যে হাসেম ফুডস আগুনে মারা যাওয়া ৫৩ জনের পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দুই লাখ টাকা করে দিয়ে তারা নিহতের পরিবার থেকে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর নিয়েছে ‘আমাদের আর কোনো দাবি-দাওয়া নেই’। এটা আরেকটা অন্যায়। মানুষের জীবন দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হতে পারে না।”
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “অতীতের এই ধরনের যত ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই দায়ীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং ঘটনার তদন্ত প্রতিবদেন প্রকাশ করা হয়নি। এ কারণে এই ধরনের ঘটনা একের পর এক ঘটছে।”
তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো হল-
কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে দুর্ঘটনা না বেল কাঠামোগত হত্যা বলে চিঞ্নিত করে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, অগ্নিনির্বাপক ও শ্রম আইনের বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব পালন করেনি, সেসব অবহেলাকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে, শ্রম আইনে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিহত, আহত ও চিকিৎসাধীন শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি কাজ হারানো শ্রমিকদের বিকল্প কর্ম ব্যবস্থা বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়া কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, সকল শিল্প কারখানায় শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিদর্শন অধিদপ্তকে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থলগুলোর খবর পাওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া, শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা, কর্মস্থলে চিকিৎসা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা, শিশুশ্রম নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এবং শিল্পখাতের তালিকাভুক্ত ও তালিকা বহির্ভূত কারখানা ভবনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুপারিশ করেছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।
হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ১৯ সদস্যের নাগরিক তদন্ত কমিটির সদস্যদের মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, মাহবুবুর রহমান ঈসমাইল, ডা. মো. হারুন-অররশিদ, প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।