জাপানি নারী নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক শরীফ ইমরানের দুই মেয়ে কোথায়, কার সঙ্গে থাকবে সে বিষয়ে বিকালে আদেশ দেবে হাই কোর্ট।
Published : 31 Aug 2021, 02:57 PM
এই সময়ের মধ্যে এসব বিষয়ে দুই পক্ষকে সমঝোতায় আসতে বলেছে আদালত।
তবে দুই পক্ষই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে শিশুদের না রেখে বাসা বা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে রাখার পক্ষে সম্মত হয়েছে।
সেখানে শিশুরা মা নাকানো এরিকো নাকি বাবা শরীফ ইমরানের সঙ্গে থাকবে, নাকি মা-বাবা উভয়ের সঙ্গে থাকবে, মা-বাবা থাকলে তাদের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারী থাকবে কিনা বা তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে কিনা, এসব বিষয়ে দুই পক্ষকে সমঝোতায় আসতে বলেছে হাই কোর্ট।
এরপর বেলা ৩টায় আদেশের জন্য রাখে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ।
আদালতে নাকানো এরিকোর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। বাবা শরীফ ইমরানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।
দুই সন্তানের অভিভাকত্ব চেয়ে জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো রিট করলে দুই শিশুকে হাজির করতে গত ১৮ অগাস্ট নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।
শিশুদের বাবা শরীফ ইমরান ও তার বোন আমিনা জেবিনকে (শিশুদের ফুফু) এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
আর হাজিরার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয় গুলশান ও আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি)।
সেই সঙ্গে রীফ ইমরান যাতে দুই মেয়েকে নিয়ে দেশত্যাগ করতে না পারে সেজন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আদালত।
এর মধ্যে গত ২২ অগাস্ট দুই শিশুকে ইমরানের বারিধারার বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারপর থেকে তারা মহানগর পুলিশের সাপোর্ট সেন্টারে ছিল।
সেখান থেকেই মঙ্গলবার দুই শিশুকে আদালতে নিয়ে আসে পুলিশ। তাদের মা-বাবা, ফুফুও আদালতে আসেন।
এরপর শুনানি শুরু হয়। এক পর্যায়ে আইনজীবীসহ দুই শিশু, তাদের মা-বাবা ও ফুপুকে খাস কামরায় ডেকে বক্তব্য শোনে আদালত।
শুনানির শুরুতে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, “বাচ্চাদের মা ঢাকার বারিধারায় একটি বাসা ভাড়া করেছেন। আমরা চাই ওই বাসায় বাচ্চারা মায়ের সাথে থাকুক। বাচ্চাদের বাবাও তার মত করে ওই বাসায় আসুক-থাকুক। কারণ, এই কয়দিনে বাচ্চাদের মধ্যে যে একটা ট্রমা তৈরি হয়েছে তা কাটুক। তারপর আপনারা এ বিষয়ে চুড়ান্ত কোনো আদেশ দেন।”
আর আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, “বাচ্চারা বাবার বাসায় থাকুক। মা বাচ্চাদের দেখতে আসুক কোনো সমস্যা নেই। মা যে বাসাটার কথা বলছে সে এরিয়ায় বাচ্চাদের থাকার বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে।”
পরে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, “আমরা চাই বাচ্চা দুটি পারিবারিক পরিবেশে থাকুক। আপনারা একটু পজিটিভলি ভাবুন।”
এরপর আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, “আমরা তাহলে দু-পক্ষ একটু বসে সিদ্ধান্ত নিই, তারপর আপনাকে জানাই। আপনি তখন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।”
এরপর আদালত বেলা ৩ টায় আদেশের জন্য রাখে।
রিট আবেদনের তথ্য মতে, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি আইন অনুযায়ী জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো (৪৬) ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) বিয়ে করেন।
এরপর তারা টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। তাদের তিন সন্তানই মেয়ে। তাদের বয়স যথাক্রমে ১১, ১০ ও ৭ বছর। তিন মেয়ে টোকিওর একটি স্কুলে পড়ছিল।
গত ১৮ জানুয়ারি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন নাকানো এরিকো। পরে ২১ জানুয়ারি ইমরান টোকিওর ওই স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার এক মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। তবে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ইমরানের আবেদন নাকচ করে।
পরবর্তীতে স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান বড় দুই মেয়েকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।
২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করলে এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি সন্তানদের জিম্মা চেয়ে টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন এরিকো।
টোকিওর আদালত আদালত গত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেয়। তবে এই আদেশ অমান্য করে শরীফ ইমরান শুধু একবার মায়ের সঙ্গে বড় দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি মিথ্যা তথ্য দিয়ে ইমরান মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন। সে আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করার পর গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন ইমরান।
পরে গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত এরিকোর অনুকূলে বড় দুই মেয়ের জিম্মা হস্তান্তরে আদেশ দেয়।
আবেদনে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে এরিকো এত দিন বাংলাদেশ আসতে পারেননি। পরে গত ১৮ জুলাই শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসেন তিনি। যদিও শ্রীলঙ্কা বিমানবন্দরে থাকার সময়ই এরিকোকে ফিরে যেতে বলেন শরীফ।
কিন্তু এরিকো বাংলাদেশে আসেন এবং নিজের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করান। গত ২০ জুলাই এরিকোর কোভিড টেস্টের ফল নেগেটিভ আসে। কিন্তু শরীফ ইমরান তা অবিশ্বাস করেননি এবং ২১ জুলাই প্রভা ক্লিনিকে কোভিড টেস্ট করাতে বলেন। প্রভা ক্লিনিকের টেস্টে ফল পজিটিভ আসে। পরে জাপান দূতাবাসের সুপরিশে আবার কোভিড টেস্ট করালে ফল নেগেটিভ আসে। কিন্তু তারপরও শরীফ ইমরান সেসব নেগেটিভ রিপোর্ট বিশ্বাস করছিলেন না। এরপর ২৪ জুলাই আবার কোভিড টেস্ট করান। সে টেস্টেও ফল নেগেটিভ আসে। এরপর দিন ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে আবার কোভিড টেস্ট করান। সে টেস্টেও কোভিড নেগেটিভ আসে।
বাংলাদেশে আসার আগেই এরিকো ফাইজারের দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন। পরে গত গত ২৭ জুলাই মোবাইলের জিপিএস বন্ধ করে এবং এরিকোর চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় মেয়েদের সাথে দেখা করানোর জন্য।
আইনজীবী শিশির মনিরের ভাষ্য, এতে প্রতীয়মান হয় যে, শরীফ ইমরান আর কখনও মেয়েদের সাথে এরিকোকে দেখা করাতে চান না এবং মেয়েরা কোথায় আছে সেটিও জানাতে চান না। যে কারণে মেয়েদের অভিভাবকত্ব চেয়ে চেয়ে রিট আবেদন করেন।