জাপানি নারীর দুই সন্তান আপাতত থাকবে পুলিশের কাছে

মা-বাবার কাছে না, আপাতত পুলিশের তত্বাবধানেই থাকছে ওই দুই শিশু; যাদের মা জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো, বাবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শরীফ ইমরান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2021, 11:57 AM
Updated : 23 August 2021, 01:33 PM

ঢাকা মহানগর পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে উন্নত পরিবেশে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিশু দুটিকে রাখতে বলেছে আদালত।

এই কয়দিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মা নাকানো এরিকো, আর বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাবা শরীফ ইমরান শিশুদের কাছে থাকতে পারবেন।

রোববার সন্ধ্যায় সিআইডি দুই শিশুকে উদ্ধারের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সোমবার এ আদেশ দেয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে আদালতের আদেশ সংশ্লিষ্টদের মৌখিকভাবে জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।

আদালতে জাপানি নারী নাকানো এরিকোরে পক্ষে শুনানিতে ছিলেন মোহাম্মদ শিশির মনির। শরীফ ইমরানের পক্ষে শুনানি করেন ফাওজিয়া করিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম শিশু দুটির মা-বাবার আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা দুজনই অভিজ্ঞ আইনজীবী। দেশি-বিদেশি বহু আইন আপনারা জানেন, জাজমেন্টও জানেন।

“কোর্টে তা ধৈর্য ধরে পড়া বা শোনার সময় আসলে কম। যাই হোক আপনারা একটা সমাধান (শিশুদের অভিভাবকত্ব নিয়ে) নিজেরাই বের করে আমাদের ৩১ অগাস্ট জানাবেন বাচ্চাদের কল্যাণের জন্য। আপনাদের কারণে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”

সন্তানদের অভিভাবকত্ব ও তাদের আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে শিশু দুটির মা নাকানো এরিকোর আবেদন করেন। 

ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১৯ অগাস্ট আদালত বাবা শরীফ ইমরানের তত্ত্বাবধানে থাকা ১০ ও ১১ বছর বয়সী দুই মেয়েকে ৩১ আগস্ট হাজির করার নির্দেশ দিয়েছিল। শরীফ যাতে দুই মেয়েকে নিয়ে দেশত্যাগ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতেও পুলিশকে বলে আদালত।

অবৈধভাবে দুই শিশুকে আটকে রাখা হচ্ছে না, এ বিষয়ে আদালতকে সন্তুষ্ট করতে শরীফ ইমরান ও তার বোন আমিনা জেবিনকে ওই দুই শিশুকে আদালতে হাজির করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, এই রুলও জারি করে।

এর মধ্যে রোববার সন্ধ্যায় সিআইডি বাবার তত্ত্বাবধানে থাকা দুই শিশুকে উদ্ধার করে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে যায়।

এই পরিস্থিতিতে শিশু দুটিকে নিজের জিম্মায় নিতে এবং জাপানি নারী নাকানো এরিকোর পাসপোর্ট আদালতের জিম্মায় নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে সোমবার আদালতে আবেদন করেন বাবা শরীফ ইমরান।

সিআইডি শিশু দুটিকে কেন ভিকটিম সেন্টারে নিয়ে গেল- আদালত জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিপুল বাগমার বলেন, “শিশু দুটির বাবা এরই মধ্যে দুই বার ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন। সিআইডির আশঙ্কা হয়েছে, তিনি শিশুদের নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন। যে কারণে শিশুদের উদ্ধার করে ভিকটিম সেন্টারে রাখা হয়েছে।”

এ আইন কর্মকর্তা আদালতকে বলেন, যেহেতু অভিভাবকত্বের বিষয়টি অমীমাংসিত, তাই নিরপেক্ষ কোনো জায়গায়, মা-বাবার যৌথ জিম্মায় দেওয়া যেতে পারে। সেটি হতে পারে কোনো পাঁচ তারকা হোটেলে। এক্ষেত্রে মা-বাবাকে খরচ বহন করতে হবে। আর তাদের জিম্মার বিষয়টি রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।

এদিকে শিশু দুটি জাপানি হওয়ায় তাদের মা নাকানো এরিকোর আইনজীবী শিশির মনির আরজি জানান জাপানের দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে শিশু দুটিকে রাখার জন্য।

তবে সার্বভৌমত্ব এবং এখতিয়ার প্রশ্নে এ আরজির বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষ ও শিশুদের বাবা শরীফ ইমরানের আইনজীবী।

শরীফ ইমরানের আইনজীবী ফাওজিয়া করিমের আরজি ছিল, আদালতে মুচলেকা দিয়ে শিশুদের বাবার কাছে দেওয়া হোক।

কিন্তু আদালত শিশুদের মা-বাবাকে সময় বেঁধে দিয়ে পুলিশ হেফাজতেই রাখতে বলল শিশু দুটিকে।

ঘটনার পূর্বাপর

আদালতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি আইন অনুযায়ী নাকানো এরিকো (৪৬) ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) বিয়ে করেন। গত ১৮ জানুয়ারি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো।

টোকিওতে এক যুগের দাম্পত্য জীবনে তারা তিন মেয়ের বাবা-মা হন। তাদের বয়স যথাক্রমে ১১, ১০ ও ৭ বছর। তিন মেয়ে টোকিওর একটি স্কুলে পড়ে।

গত ২১ জানুয়ারি ইমরান টোকিওর ওই স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার এক মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন। তবে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই আবেদন নাকচ করে।

পরে স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান বড় দুই মেয়েকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান বলে এরিকো জানান।

পরে ২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করলে এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন।

এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি সন্তানদের জিম্মা চেয়ে টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন এরিকো।

টোকিওর আদালত আদালত গত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেয়।

তবে এই আদেশ অমান্য করে শরীফ ইমরান শুধু একবার মায়ের সঙ্গে বড় দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন বলে জানান এরিকো।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইমরান মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করার পর গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন ইমরান।

এদিকে গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত এরিকোর অনুকূলে বড় দুই মেয়ের জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেয়।

রিট আবেদনে এরিকো বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এত দিন বাংলাদেশে আসতে পারেননি তিনি। গত ১৮ জুলাই শ্রীলঙ্কা হয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন।

মেয়েদের দেখা পেতে এরিকো বাংলাদেশে এসে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার পর ফল নেগেটিভ আসে, কিন্তু শরীফ ইমরান তা অবিশ্বাস করেন এবং ২১ জুলাই প্রাভা হেলথকেয়ারে কোভিড টেস্ট করাতে বলেন।

প্রাভায় প্রথমে ফল পজিটিভ এসেছিল। পরে জাপান দূতাবাসের সুপারিশে আবার কোভিড পরীক্ষা করালে ফল নেগেটিভ আসে।

কিন্তু শরীফ ইমরান তা বিশ্বাস করছিলেন বলে আরও দুই দফায় কোভিড পরীক্ষা করান এরিকো। তাতেও ফল নেগেটিভই আসে। তিনি বাংলাদেশে আসার আগেই ফাইজারের দুই ডোজ টিকা নেন।

এরিকো জানান, ইমরান মেয়েদের সঙ্গে দেখা করাতে গত ২৭ জুলাই তাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়েছিল।

এতে তার মনে আশঙ্কা হয়, ইমরান মেয়েদের আর কখনও তার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না। এই কারণে তিনি রিট আবেদন করেন।