জুলহাজ-তনয় হত্যা: আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার আশায় পরিবার

সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যা মামলার রায়ে সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়াসসহ আট আসামির মৃত্যুদণ্ড হবে বলেই আশা করছে পরিবার।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2021, 04:15 PM
Updated : 30 August 2021, 04:24 PM

জুলহাজের বড় ভাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, “আমরা ন্যায়বিচার চাই। অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা হবে, সেই প্রত্যাশাই আমরা করছি।”

ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান মঙ্গলবার বেলা ১১টার পর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন। রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২৩ অগাস্ট তিনি রায়ের জন্য এ দিন ঠিক করে দিয়েছিলেন।

দেশে ধারাবাহিক জঙ্গি হামলার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডের বাড়িতে প্রবেশ করে ইউএসএইড কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু থিয়েটারকর্মী মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১২ মে জিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক মুহম্মদ মনিরুল ইসলাম। এরপর গত বছরের ১৯ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত।

এ মামলার আসামিরা হলেন- চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ, সাব্বিরুল হক চৌধুরী, জুনাইদ আহমদ ওরফে মওলানা জুনায়েদ আহম্মেদ ওরফে জুনায়েদ, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, শেখ আব্দুল্লাহ ও আসাদুল্লাহ।

আসামিদের মধ্যে প্রথম চারজন পলাতক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। পরের চারজন কারাগারে আছেন।

তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য। আসামিদের মধ্যে জিয়া, মোজাম্মেল, আরাফাত ও আকরাম বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

এছাড়া প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় জিয়া, আকরাম, মোজাম্মেল ও শেখ আব্দুল্লাহর ফাঁসির রায় এসেছে এ বছরের শুরুতে।

যুক্তিতর্ক

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর গোলাম ছারোয়ার খান জাকির।

কারাগারে থাকা চার আসামির পক্ষে অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম ও খায়রুল ইসলাম লিটন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। আর পলাতক চার আসামির পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী মো. জাকির হোসেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, “আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আশা করছি, আদালত তাদের সর্বোচ্চ সাজা দেবে।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী খায়রুল ইসলাম লিটন যুক্তি তর্কে বলেন, “আমার মক্কেলকে দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে জোর করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়। ৮ আসামির মধ্যে ৪ জনেরই ১৬৪ ধারায় জবানরবন্দি রয়েছে। অন্য মামলা থেকে এ মামলায়  অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে। সব হয়েছে আইনি কাঠামোর বাইরে।”

আসামিপক্ষের অপর  আইনজীবী  নজরুল ইসলাম ইসলাম বলেন  “আমার আসামিরা সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ঘটনাস্থলে তারা ছিলেন না। তাদেরকে এ মামলায় অন্যায়ভাবে জড়ানো হয়েছে, যা আমরা  রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরা করে তুলে আনতে পেরেছি। তাই  রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তারা খালাস পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।”

জুলহাজ-তনয় হত্যার এক বছর পূর্তিতে ২০১৭ সালে শাহবাগে মোমবাতি জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে ফ্রি থিংকার্স মুভমেন্ট বিডি নামের এক সংগঠন।

‘দুই মাসের প্রস্তুতি’ ছিল খুনিদের

দেশজুড়ে ‘উগ্রপন্থিদের’ একের পর এক হত্যা-হামলার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে জুলহাজ মান্নান ও তনয়কে হত্যার ঘটনা পুরো দেশকে নতুন করে চমকে দেয়।

৩৫ বছর বয়সী জুলহাজ মান্নান  ছিলন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনির খালাতো ভাই। ইউএসএইডের আগে তিনি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রটোকল অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবেও কাজ করেন। সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন জুলহাজ।

আর তার বন্ধু ২৬ বছর বয়সী মাহবুব রাব্বী তনয় ছিলেন লোকনাট্য দলের কর্মী। পিটিএ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ‘শিশু নাট্য প্রশিক্ষক’ হিসেবেও তিনি কাজ করতেন।

লেকসার্কাস রোডের আছিয়া নিবাস নামে ছয়তলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে মাকে নিয়ে থাকতেন জুলহাজ। সেদিন বিকাল ৫টার দিকে টি শার্ট ও প্যান্ট পরা একদল যুবক ওই বাসায় যায়।

পার্সেল দেওয়ার কথা বলে তারা জুলহাজ মান্নানের ফ্ল্যাটে যেতে চাইলে বাসার নিরাপত্তাকর্মী তাদের ঢুকতে দেন। নক করার পর জুলহাজ দরজা খুলে তাদের দেখে আবার দরজা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

তখন তারা জোর করে বাসায় ঢুকতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী পারভেজ মোল্লা বাধা দেন। পরে তারা ঘরে ঢুকে জুলহাজ ও তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে।

হামলাকারীরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে বলতে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা সে সময় জানিয়েছিলেন।

যাওয়ার পথে তাদের আটকাতে গিয়ে মমতাজ নামে পুলিশের একজন এএসআই জখম হন। তবে হামলাকারদের একজনের কাছ থেকে একটি ব্যাগ ছিনিয়ে রাখেন কলাবাগান এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এএসআই মমতাজ; সেখানে একটি পিস্তল, একটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও মোবাইল ফোন পাওয়া যায়।

ঘটনার রাতেই জুলহাজের ভাই মিনহাজ মান্নান অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এএসআই মমতাজের ওপর হামলা এবং অস্ত্র পাওয়ার ঘটনায় আরেকটি মামলা করেন কলাবাগান থানার এসআই শামীম আহমেদ।  অস্ত্র আইনের ধারায় করা মামলাটি এখনও তদন্তাধীন।

সিসি ক্যামেরার ছবিতে দৌড়ে পালানো এক যুবক, যাকে অন্যতম খুনি বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা

সে সময় আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ (একিউআইএস) শাখা ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে খবর এলেও পুলিশের পক্ষ থেকে দেশীয় উগ্রপন্থিদের দায়ী করা হয়; বলা হয়, দেশীয় জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক মুহম্মদ মনিরুল ইসলাম ২০১৯ সালের ১২ মে জিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তখনকার উপ-কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান সে সময় বলেছিলেন, এ মামলায় গ্রেপ্তার চার আসামি অপরাধে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

“দীর্ঘ তদন্তে আসামিদের জবানবন্দি ও অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জানা গেছে, আসামিরা নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন পর্যায়ের সক্রিয় সদস্য। সংগঠনের নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হকের নির্দেশে সংগঠনের সামরিক শাখার সদস্যরা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।”

১২ মে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে ওই হত্যাকাণ্ডে ১৩ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছিল কাউন্টার টেরোজিম ইউনিট। অভিযোগপত্রের আট জন ছাড়া বাকিদের পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি। সে কারণে তাদের আসামির তালিকায় রাখা সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন