চাপাতির শিকার এবার সমকামী অধিকারকর্মী

লেখক, শিক্ষক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, ভিন্ন মতের ইসলামী ভাবধারা অনুসারী ও বিদেশির পর এবার দুর্বৃত্তের চাপাতির আঘাতে নিহত হয়েছেন সমকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার কর্মী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2016, 01:16 PM
Updated : 25 April 2016, 06:49 PM

রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হত্যাকাণ্ডের দুদিনের মাথায় সোমবার বিকালে রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাসে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে খুন করা হয় জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু এক নাট্যকর্মীকে।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ (৩৫) সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল অ্যাসিস্টেন্ট জুলহাজ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক দীপু মনির খালাত ভাই।

তার সঙ্গে নিহত ব্যক্তির নাম মাহবুব রাব্বী তনয় (২৬)। লোকনাট্য দলের কর্মী তনয় অধিকারকর্মী জুলহাজের বন্ধু ছিলেন। হামলায় দুজনে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।

তনয় পিটিএ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ‘শিশু নাট্য প্রশিক্ষক’ হিসাবে কাজ করতেন বলে তার টুইটার অ্যাকাউন্টে বলা হয়েছে।

হামলাকারীদের অস্ত্রাঘাতে পারভেজ মোল্লা নামে বাড়ির এক দারোয়ান আহত হয়েছেন। তাদের বাধা দিতে গিয়ে মমতাজ নামে এক এএসআই আহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন ডিএমপির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান।

খুনিদের আনা পার্সেল ছিল বর্জ্যভরতি

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, টি শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পরিহিত হামলাকারী যুবকরা খুনের পর  ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে বলতে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়।   

কারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পুলিশ জানায়নি। তবে গত কয়েক বছরে ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট খুন যেভাবে হয়েছিল, জুলহাজ হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে একইভাবে।

গত শনিবার রাজশাহী নগরীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে একই ভাবে কুপিয়ে হত্যার সঙ্গেও জঙ্গিদের দিকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহের তীর।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক খুনের দুদিনের মাথায় সোমবার সকালে গাজীপুরের কাশিমপুরের কারাফটকের কাছে এক সাবেক কারারক্ষী খুনের পর এগুলোকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জুলহাজসহ দুজনকে হত্যা করা হয়।  

জুলহাজকে হত্যার জন্যই খুনিরা গিয়েছিল বলে ঘটনাপ্রবাহে মনে করছেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।

র‌্যাবের ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের পরিচালক আবুল কালাম আজাদও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনাটি পরিকল্পিত।”

জুলহাজ মান্নান

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনার সঙ্গে জুলহাজ মান্নান

লেকসার্কাস রোডের আছিয়া নিবাস নামে ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে মা ও  থাকতেন জুলহাজ। বিকাল ৫টার দিকে সেখানেই দুর্বৃত্তরা হানা দেয় বলে বাড়ির পাহারাদার সুমন জানিয়েছেন।

আহত সহকর্মী পারভেজ মোল্লাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান সুমন।

সুমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকাল ৫টার দিকে ওই যুবকরা দ্বিতীয় তলায় জুলহাস ও আরেকজনকে কুপিয়ে যায়। তখন পারভেজ মোল্লা এগিয়ে গেলে তাকেও কোপ দেয়।”

আহত দারোয়ান পারভেজ মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, বিকাল ৫টার দিকে তিন যুবক পার্সেল দেওয়ার কথা বলে জুলহাজ মান্নানের ফ্ল্যাটে যেতে চান। তাদের ঢুকতে দিয়ে তিনিও পেছন পেছন দোতলায় ওঠেন।

“দরজা নক করলে জুলহাজ স্যার দরজা খোলেন। তাদের দেখে আবারও দরজা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন তারা বাসায় জোর করে ঢুকতে চায়।”

মাহবুব রাব্বী তনয়

“আমি তাদের বলি, স্যার যেহেতু ঢুকতে দিতে চান না, আপনারা চলে যান। এ কথা বলার পরই আমাকে আঘাত করে।”

পারভেজ লুটিয়ে পড়লে ওই যুবকরা জোর করে ঘরে ঢুকে জুলহাজ ও তার সঙ্গে থাকা অন্যজনকে (তনয়) কোপাতে থাকে বলে জানান দারোয়ান পারভেজ।

“ওই সময়ে আমি চিৎকার করি, স্যারও চিৎকার করতে থাকেন। ওই সময় বাসার নিচে কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজও পাই। হুলুস্থুল পরিস্থিতিতে কখন তিনজন বাসা থেকে বের হয়ে যায়, বুঝতে পারিনি।”

ওই ভবনের এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভয়ে কেউ দরজা খোলেনি। চিৎকারের শব্দ শুনেও কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি।”

ঘটনার পরপরই জুলহাজের ঘরে ঢুকে দেখে আসা ওই ভবনের আরেক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাসায় ঢুকে দেখি বেডরুমে একজন ও দরজার কোনায় একজন মাটিতে পড়ে আছে।”

খুনিদের পালিয়ে যেতে দেখেছেন, এমন এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৫/৭ জন যুবক ওই বাসা থেকে বের হয়েছিল। তাদেরকে কয়েকজন ধাওয়াও করেছিল।

“তারা ‘আল্লাহু আকবর’ বলতে বলতে তেতুলতলা মাঠ দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।”

এই বাড়িতেই খুন

লাশ বের করা হচ্ছে

ওই যুবকদের অন্তত চারজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখেছেন জানিয়ে এই নারী বলেন, “তারা ওই বাসা থেকে বের হওয়ার পর কয়েক বার গুলি ছুড়েছিল।”

হামলাকারী যুবকরা টি শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরিহিত ছিল বলে জানান এই প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ দেখেছেন বলেও জানান তিনি। 

এর আগে এই ধরনের কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে হামলাকারীদের ব্যাগে অস্ত্র বহনের কথা জানিয়েছিল পুলিশ। 

ঘটনাস্থলে থাকা পিবিআইয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাঁচজনের একটি দল ওই বাসায় ঢুকেছিল। তারা দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়।”

পালানোর সময় দুর্বৃত্তদের বাধা দিতে গিয়ে মমতাজ নামে এক এএসআই আহত হন বলে ডিএমপির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

এএসআই মমতাজ হামলাকারীদের একজনের কাছ থেকে একটি ব্যাগ ছিনিয়ে রাখেন বলে শিবলী নোমান জানিয়েছেন।

ওই ব্যাগে ‘গুরুত্বপূর্ণ আলামত’ পাওয়া গেছে বলে ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।