সকাল পৌনে ১০টা। ঢাকার মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকা। মুদি, মোবাইল বিল রিচার্জ, লন্ড্রি, ইলেক্ট্রনিক্সসহ বিভিন্ন পণ্যের বেশ কিছু দোকান খোলা। তবে বেশিরভাগ দোকানের শাটার আধখোলা। হঠাৎ বাইরে একজন চিৎকার করে উঠলেন- “আইছে, আইছে।”
Published : 26 Jul 2021, 12:50 PM
প্রায় একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল সবগুলো খোলা থাকা দোকানের শাটার। প্রায় এক ছন্দে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফল, সবজি বিক্রি করা ফেরিওয়ালারাও ভ্যান নিয়ে সরে গেলেন গলির ভেতর। তখনই দেখা গেল মোহাম্মদপুর থানার একটি টহল গাড়ি।
মোহাম্মাদীয়া হাউজিং এলাকায় টহল দিয়ে কালভার্ট পার হয়ে সেই গাড়ি গেল লোহার গেইট এলাকার দিকে। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার মিনিট খানিক পরে আবার উঠে গেল দোকানের শাটার। কিছু দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন আটকা পড়া ক্রেতারা।
ঈদের পর শুরু হওয়া ‘কঠোরতম লকডাউনের’ চতুর্থ দিন সোমবার দেখা গেল এমন চিত্র। তবে এমন ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই, দিনে কয়েকবার।
পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার পর পাশেই আরেক দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন এক ক্রেতা, নাম বললেন আমজাদ ইসলাম।
জিজ্ঞেস করতে বললেন, “টুকটাক জিনিস কেনার ছিল। কিন্তু পুলিশ দোকান বন্ধ করে দিলেতো কিছুই করার থাকে না। খোলা থাকলেই বরং সুবিধা। এই যেমন আমি বদ্ধ জায়গায় মিনিটখানেক ছিলাম, এটাতো স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।”
মিরপুরের রূপনগর এলাকার মহল্লাগুলোতেও মোহাম্মদপুরের মত প্রায় একই অবস্থা দেখা গেল। মোড়ে আড্ডা দিতে থাকা কমবয়সীদের জটলা থেকে টহল পুলিশ দেখলেই এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে শিষ দিয়ে কিংবা ফোনে জানিয়ে দিচ্ছে পুলিশ আসার খবর। এরপর সুবিধামতো জায়গায় সরে যাচ্ছে তরুণ-যুবাদের দল। আবার পুলিশ চলে গেলেই হইহুল্লোড় করছে। তাদের বেশিরভাগের মুখে মাস্ক নেই।
“আমরা এক দিকে গেলে তারা দৌড়ে অন্য দিকে গিয়ে চিল্লাচিল্লি করে। যেন আমাদের পাগল পেয়েছে। তারপরও আমরা মাথা ঠাণ্ডা রেখে ডিউটি করার চেষ্টা করছি।”
রূপনগর এলাকায় ওষুধের দোকান, হোটেল রেস্তোরাঁ ও মুদি দোকান খোলা দেখা গেল। সেগুলো খোলার অনুমতি দেওয়া আছে। কিন্তু অনুমতি নেই- এমন দোকানও খুলছে এখন।
‘বুকিশ’ নামের একটি বইয়ের দোকান খুলেছে সকাল ১০টার দিকে। জানতে চাইলে মালিক মো. মুস্তফা বলেন, “বাজার করার টাকা নেই। পেটতো চালাতে হবে। তাই ঝুঁকি নিয়ে দোকান খুলেছি।”
এ এলাকায় রিকশা ও মোটর সাইকেল চলছে, মাঝে মধ্যে দুয়েকটি প্রাইভেট কারও যাচ্ছে। তবে অন্য কোনো যানবাহন চলতে দেখা যায়নি।
সিদ্ধেশ্বরী এলাকার অলি-গলিতেও ছোট ছোট দোকানপাট খোলা রয়েছে, বেশিরভাগই শাটার অর্ধেক বন্ধ রেখে।
ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, সাত মসজিদ রোড এলাকায় প্রধান সড়কে সোমবার রিকশা চলাচল বেড়েছে। অলিগলিতে কিছু দোকানপাটও খোলা।
তল্লাশি চৌকিগুলোতে পথচারী ও গাড়িচালকদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা গেছে। সেসব জায়গায় যানবাহনের কিছুটা জটলা তৈরি হচ্ছে।
সাত মসজিদ রোড এলাকায় জনাদশেক সাইকেল আরোহীকে দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেল। বেলা ১১ টার দিকে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য জহিরুল বললেন, “এখনো পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন, তখন দেখা যাবে।”
মাছ বিক্রেতা নুরুল ইসলাম বের হয়েছিলেন ভ্যান নিয়ে। বললেন, ঈদের পর এই প্রথম বের হলেন। লোকজন কম, বেচা-বিক্রিও তেমন নেই।
দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনের চতুর্থ দিনে পুরান ঢাকার অলিগলি ও প্রধান সড়কে মানুষের চলাচল আর গাড়ি চলাচল রোবারের চেয়ে বেড়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দোকানও খুলছে।
লালবাগ চৌরাস্তা, ঢাকেশ্বরী, পলাশীর মোড় ও বকশিবাজারে অলিগলিতে মানুষের চলাচল দেখা গেছে।
চুড়িহাট্টার হায়দার বক্স লেইনে গিয়ে দেখা গেছে এলাকা প্রায় জনমানবশূন্য। তবে চক মোগলটুলী রোডে দেখা গেল অনেক মানুষের আনাগোনা।
নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, হাতিরপুল, গ্রিনরোড এলাকায় সড়ক জুড়ে রয়েছে রিকশা, চলছে ব্যক্তিগত গাড়িও। তবে এসব এলাকায় সাইরেন বাজিয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চলতে দেখা গেছে অনেক বেশি।
গ্রিন রোড এলাকার রিকশা চালক মো. কাইয়ুম বলেন, “সকালে লকডাউন অনেকটা কঠোর থাকলেও সন্ধ্যার পরপর চলাচল সহজ হয়ে যায়। যত দিন যাচ্ছে লকডাউনে লোকজন বেশি বের হচ্ছে।”
ষাট ফুট সড়কের ভাঙ্গা ব্রিজ এলাকায় বসেছে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন জনাদশেক পুলিশ সদস্য।
কর্তব্যরত একজন এসআই বললেন, “আজকে গাড়ি ঘোড়া ও মানুষের চাপ তুলনামূলক কম। এর মাঝেও কিছু কিছু লোকজন রাস্তায় বের হওয়ার উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারছে না। তাদেরকে আমরা কিছুক্ষণের জন্য দাঁড় করিয়ে রাখছি।”
আগারগাঁওয়ে ইউনিসেফ কার্যালয়ের সামনে প্রতিদিন আট-দশটি ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে থাকে। সোমবার সকাল ১০টার দিকে দেখা গেল মাত্র দুটি।
আগারগাঁওয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসা রোগীর স্বজনদের গন্তব্যে যেতে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। আগারগাঁও থেকে মহাখালী যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল চালকরা ভাড়া চাচ্ছিলেন আড়াইশো টাকা। বাংলামোটর যাওয়ার জন্য রিকশা চালকরা চাচ্ছিলেন ২০০ টাকা করে।
একটি ওষুধ কোম্পানিতে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত সিদ্দিকুর রহমান জানালেন, তিনি যাবেন মহাখালীতে। তিনিও রিকশার অপেক্ষায় ছিলেন।
ফকিরাপুল, পল্টন, শাহজাহানপুর, বিজয়নগর সড়ক ঘুরে দেখা গেল লকডাউনের চতুর্থ দিনে রাস্তায় রিকশা ও ভ্যানের পাশাপাশি চলছে প্রাইভেট কার, মোটর বাইক ও সরকারি যানবাহন। সড়কে যানবাহন ও মানুষের চলাচল বেড়েছে।
কাকরাইলের কাছে পুলিশের চেকপোস্টের সামনে কড়াকড়ি বেশি। গাড়ি ও রিকশার যাত্রীদের থামিয়ে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, কেন তারা বের হয়েছেন। সঠিক জবাব না পেলে রিকশা থেকে যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, প্রাইভেট কার চালকদের করা হচ্ছে জরিমানা।
শান্তিনগরের কাছে চেকপোস্টেও একই দৃশ্য। পুলিশের কড়াকড়িতে এসব চেকপোস্টে কিছুটা জটলাও তৈরি হচ্ছে মাঝে মধ্যে।
শাহজাহানপুরের বাসিন্দা জীবন ইসলাম একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন, অফিস মতিঝিলে। গলায় পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে হেঁটেই যাচ্ছেন কর্মস্থলে।
তিনি বললেন, “লকডাউন ঘোষণা হলেও আপনি দেখবেন ভেতরে ভেতরে মতিঝিলে অনেক প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। সেখানে কাজ-কর্মও চলছে। ফলে আমাদেরকে কাজের প্রয়োজনেই বের হতে হচ্ছে।”