অগ্নিকাণ্ড: হাসেম ফুডসের মালিকসহ ৮ জন হত্যামামলায় রিমান্ডে

হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে অর্ধ শতাধিকের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যামামলা হয়েছে। সেই মামলায় এর মালিক মো. আবুল হাসেম ও তার চার ছেলেসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2021, 11:01 AM
Updated : 10 July 2021, 03:17 PM

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের এই কারখানায় বৃহস্পতিবার অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনায় ব্যাপক আলোচনার মধ্যে শনিবার পুলিশ বাদী হয়ে থানায় মামলা করে।

এই ধরনের ঘটনাগুলোতে এর আগে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনতে দেখা গেলেও রূপগঞ্জের ভূলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন মজুমদারের করা এই মামলায় ৩০২ ধারায় সরাসরি হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ এনে ৩০২সহ কয়েকটি ধারায় এই মামলা হয়েছে।

মামলায় হাসেমসহ আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যার উদ্দেশ্যে সামান্য ও গুরুতর জখম করার অভিযোগও আনা হয়েছে। ধারা দেওয়া হয়েছে দণ্ডবিধির ৩০২, ৩২৩, ৩২৪, ৩২৫, ৩২৬ ও ৩০৭। 

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আগুনে পোড়া হাসেম ফুডস কারখানা থেকে হতভাগ্য শ্রমিকদের লাশ বের করে আনছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মামলা দায়েরের পরপরই ঢাকার ফার্মগেইটের সেজান পয়েন্ট ভবনে সজীব গ্রুপের অফিস থেকে প্রতিষ্ঠানটির সিইও শাহানশাহ আজাদকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।

এই সময় রূপগঞ্জে অগ্নিবিধ্বস্ত কারখানাটি পরিদর্শনে যাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এই ঘটনায় আটজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে বলেন, দায়ী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রূপগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ুন কবির মোল্লা কারখানা মালিক হাসেমসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানোর কথা জানান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মামলার আট আসামিকেই ১০ দিনের জন্য রিমান্ডে চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ফাহমিদা খাতুনের আদালতে তোলা হয় আসামিদের।

শুনানি শেষে বিকালে তিনি আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিন পুলিশ হেফাজতের  আদেশ দেন বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান ইসমাইল।

আদালত থেকে বের হওয়ার হাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে বলেন, “আমার কোনো বক্তব্য নেই। মামলা হয়েছে, সেখানেই সব হবে।”

গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে হাসেমের চার ছেলে রয়েছেন, যারা কোম্পানির পরিচালক। তারা হলেন- হাসীব বিন হাসেম (৩৯), তারেক ইব্রাহীম (৩৫), তাওসীব ইব্রাহীম (৩৩) ও তানজিম ইব্রাহীম (২১)।

এছাড়া সজীব গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহানশাহ আজাদের সঙ্গে আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছেন হাসেম ফুডসের উপমহাব্যবস্থাপক মামনুর রশীদ এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জ্বলছে হাসেম ফুডস কারখানা; শুক্রবার সকালে আগুন নেভোনোর চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসেমের মালিকানাধীন হাসেম ফুডস কারখানায় সেজান, সজীব, কুলসন, নসিলাসহ ১১টি ব্র্যান্ড নামের বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হত।

এক সময় আমদানি করা পণ্য বিপণনের ব্যবসায় যুক্ত থাকলেও ২০০০ সালে নারায়ণগঞ্জে কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু করে সজীব গ্রুপ।

রূপগঞ্জের কম্পাউন্ডে যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে, সেটা নির্মাণ করা হয় চার বছর আগে। পুরো কম্পাউন্ডের সবগুলো ইউনিট মিলিয়ে প্রতি শিফটে ৭০০ শ্রমিক কাজ করতেন।

হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পর সেখানে ত্রুটিপূর্ণ অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা, জরুরি নির্গমন পথে তালা লাগানোর বিষয়টি প্রকাশ পায়। কারখানাটিতে শিশু শ্রমিক ব্যবহারের বিষয়টিও হয় প্রকাশ্য।

বৃহস্পতিবার আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভবনটির যে আয়তন, তাতে পাঁচটি সিঁড়ি থাকা দরকার ছিল।

“অথচ আমরা পেলাম মাত্র দুটি এক্সিট। এর মধ্যে প্রথম এক্সিট ছিল আগুনের মধ্যে। শুরুতেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেখানে কেউ যেতে পারেনি।”

ভবনটিতে ফায়ার সেইফটি ইকুইপমেন্ট কী কী দেখেছেন এবং তা পর্যাপ্ত ছিল কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত তেমন কিছু দেখতে পাইনি। সেরকম কোনো বিষয় চোখে পড়েনি।”

আহতদের মধ্যে অনেক শিশু শ্রমিক এখনও হাসপাতালে কাতরাচ্ছে।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ নুসরাত শনিবার আহতদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত করে শিশুশ্রম ও অন্যান্য গাফিলতির বিষয়গুলো প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ব্যবসায়ী হাসেম অবশ্য অর্ধশত মৃত্যুর দায় নিতে নারাজ।

তিনি অগ্নিকাণ্ডের পর শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “এই কারখানা কম্পাউন্ডে আমরা ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। দুই হাজারের বেশি শ্রমিকের সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে। নিয়মকানুন মেনেই আমরা ব্যবসা করছি। কিন্তু শেষ জীবনে এসে বড় পরীক্ষার মুখে ফেলে দিল এই অগ্নিকাণ্ড।”