বুড়িগঙ্গা পারে আগে প্রতিটি নৌকা যাত্রী নিত ছয়জন, একেকজনের কাছ থেকে ৫ টাকা করে নেওয়া হত, এক পারে মাঝির উঠত ৩০ টাকা।
Published : 06 Jul 2021, 12:29 AM
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে একেকবারে যাত্রী সংখ্যা চারজন বেঁধে দিয়েছে ঘাট কর্তৃপক্ষ; তবে ক্ষতি পোষাতে ভাড়া বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ টাকা। তাতে একেক পারে মাঝি ৪০ টাকা পাচ্ছে।
কিন্তু তাতেও খুশি হতে পারছেন না মাঝিরা।
কেন- এই প্রশ্নে আবদুস সালামের উত্তর আসে, “সকালে নৌকা লইয়া নামছি, দুপুর শেষ হইয়া গেছে ১০০ ট্যাহাও ইনকাম নাই। আগে ৬০০-৭০০ ট্যাহা থাকত। অহন এই ট্যাহায় নৌকা ভাড়া দিমু কী? নিজে খামু কী?”
৪০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গায় নৌকা বাইছেন পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের ৫৮ বছর বয়সী সালাম। থাকেন নদীর ওপারে জিঞ্জিরা বাজার এলাকায়।
তার মতো অন্য মাঝিরাও বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যে এক সপ্তাহের লকডাউন গত ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে, তাতে যাত্রী খরায় তাদের আয় বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
লকডাউনের তৃতীয় ও চতুর্থ দিন ঢাকার সদরঘাটের পাশে বুড়িগঙ্গা পারের লালকুঠি, ফরাশগঞ্জ, ওয়াইজঘাট, বাদামতলী খেয়াঘাটে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রী খুবই কম বলে চেনা হৈ হুল্লোড় নেই। মাঝিরা অলস সময় কাটাচ্ছেন।
মাঝিরা বলছেন, তাদের নিয়মিত যাত্রী হচ্ছে ছোট ব্যবসায়ী আর দোকানকর্মীরা। কিন্তু লকডাউনের কারণে দোকানপাট বন্ধ থাকায় গত তিন ধরে যাত্রী নেই বললেই চলে। আগে ৫ মিনিটেই নৌকা ভরে যেত এখন, আধা ঘণ্টায়ও যাত্রী মেলে না।
ওয়াইজ ঘাট থেকে ওপারের আগানগর সেতু ঘাটে নৌকা চালানো সালাম বলেন, “আগে বইসা থাহনের টাইম আছিল না, পাল্লা দিয়া নৌকা বাইতাম। আর আইজকা দুই-তিন দিন ধইরা বইসা, যাত্রী নাই।”
সর্বাত্মক লকডাউনে অন্য সব জায়গার মতো বদলে গেছে সদরঘাটের বাদামতলী এলাকার চেহারা। নেই চিরচেনা ভিড়। দেশি-বিদেশি ফলের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার এই বাদামতলীতে আগের মতো নেই গাড়ির জটলা।
বাদামতলী ঘাট থেকে জিঞ্জিরার আলম মার্কেটসহ নদীর ওপারের বেশ কয়েকটি ঘাটে তিনশর মতো নৌকা সবসময় চলাচল করে। কিন্তু লকডাউনের পর তা অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বাদামতলী থেকে আলম মার্কেট ঘাটের মাঝি শাহাদাত হোসেন বলেন, “এই লকডাউনে বেঁচে আছি পরিবার বাড়ি থাকার কারণে। এতক্ষণে (সকাল থেকে দুপুর) ৫০০-৬০০ টাকা পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখন মাত্র ১৮০ টাকা ভাড়া মারছি। নৌকা ভাড়া দিয়ে সারা দিন পরে হয়ত ২০০ টাকা থাকব। এই অবস্থায় টিকে থাকাই কঠিন।”
ঘাটগুলোর বেশিরভাগ মাঝিই ভাড়ায় নৌকা চালায়। সারা দিনে প্রতি নৌকার ভাড়া ১০০ টাকা। এর বাইরে ঘাটের খরচ আছে বলেও জানান তারা।
লালকুঠি ঘাটের মাঝি মো. জাফর বলেন, “আমি এই ঘাটে ১৫ বছর ধরে নৌকা চালাই। গত বছরের লকডাউনের শুরুতে এমনটা কয়েকদিন ছিল। তবে এবার যাত্রী পাওয়াই কঠিন। আগে যেখানে দুই-তিন মিনিট বসে থাকতে হত, এখন আধা ঘণ্টার বেশি সময় সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকতে হয়। কোনমতে নৌকা ভাড়া, ঘাটের খরচ দিয়ে দেড়শ টাকার মতো হয়।”
লালকুঠি ঘাটে নৌকা ভেড়ানো মাঝি মো. আবুল কাশেম বলেন, “ভাড়া ৫ টাকার জায়গায় ১০ টাকা হইলেও যাত্রী তো নাই। এক ঘণ্টা বসে তেল (ওপারের) ঘাট থেকে এখানে আসছি। এখন আর কতক্ষণ বসে থাকতে হয়, কে জানে?”
৬০ বছর বয়সী ফরাশগঞ্জ ঘাটের মাঝি গফুর মিয়া বলেন, “লোকজন না নামলে, ভাড়া হবে কেমনে? অনেকক্ষণ পরে পরে লোকজন আসে।”
যাত্রী কমে গেলেও মাঝি কমেনি। ফলে সিরিয়াল পেতেও অনেক সময় লাগে একেক মাঝির।
গফুর মিয়া বলেন, “আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টা পরে সিরিয়াল পাই। খোরাকির পয়সাও হয় না। কেউ বিশ্বাস করবে কি না জানি না, পেট ভরে খাওয়ার পয়সা পাই না।”
“আমাদের দেখার কেউ নাই,” হতাশ কণ্ঠে বলেন মাঝি সালাম।